বই ফেরি করেই সুখী জীবন গড়েছেন প্রতিবন্ধী শরিফুল

প্রতিবন্ধী হলেও অদম্য শরিফুল ইসলাম। মোটরসাইকেলে বই সাজিয়ে নিয়ে ছুটছেন ক্রেতার খোঁজে। সম্প্রতি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা শহরে
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শরিফুল ইসলামের জীবনটাই যেতে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত সুস্থ হলেও তাঁর একটি হাত কেটে ফেলতে হয়। ছোটবেলার ওই ঘটনা তাঁকে আর দশজন প্রতিবন্ধীর মতোই অসহায় জীবনে ছুড়ে ফেলতে পারত। তবে তেমনটা ঘটতে দেননি অদম্য মনোবলে বলীয়ান শরিফুল। নামমাত্র পুঁজি নিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এ পেশা দিয়েই তিনি সুখী জীবন গড়েছেন।

শরিফুল ইসলাম (৩৮) নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা শহরের উত্তরা আবাসন এলাকার বাসিন্দা। তিনি বই কিনে ফেরি করে বিক্রি করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখন আছেন বেশ সুখে।

ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ছে। আমি সুখে আছি। বই বিক্রির মধ্যে আলাদা একটি আনন্দ আছে। এটা বলে বোঝানো যাবে না। আমার বইয়ে মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠেছে। পাঠকেরা অনেক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, এটাই আমার বাড়তি পাওয়া।
শরিফুল ইসলাম, বইয়ের ফেরিওয়ালা, সৈয়দপুর, নীলফামারী

শরিফুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পরিবারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ছে। আমি সুখে আছি। বই বিক্রির মধ্যে আলাদা একটি আনন্দ আছে। এটা বলে বোঝানো যাবে না। আমার বইয়ে মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠেছে। পাঠকেরা অনেক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, এটাই আমার বাড়তি পাওয়া।’
ঘটনাটা ১৯৯৮ সালের। জমিতে পড়ে গিয়েছিল ১১ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক তার। তা সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন শরিফুল। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এতটাই গুরুতর যে বাঁচার কথাই ছিল না তাঁর। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর ডান হাত কেটে ফেলতে হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া।

২০১৩ সালে শরিফুলকে ব্যবসা করার জন্য ৪০০ টাকা দেন বাবা। সামান্য সেই পুঁজি দিয়ে কয়েকটা বই কেনেন। হেঁটে হেঁটে সৈয়দপুর শহরের উত্তরা আবাসন এলাকায় গিয়ে বইগুলো বিক্রি করেন। কিছুদিন এভাবে ব্যবসা করার পর অল্প কিছু টাকা জমাতে সক্ষম হন শরিফুল। সেই টাকা দিয়ে একটি রিকশাভ্যান কেনেন। তাতে করে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বই বিক্রি করতে লাগলেন। এভাবে পুরোদস্তুর বইয়ের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠলেন তিনি। এরই মধ্যে বিয়ে করেন শরিফুল। এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। রিকশাভ্যানে করে বই বিক্রি করতে নানা সমস্যা হয় তাঁর। তাই কিস্তিতে একটি মোটরসাইকেল কিনে তাতে করে সহজেই এলাকা ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করতে পারছেন শরিফুল।

শরিফুল বই কেনেন পাঠকের চাহিদা বুঝে। এলাকা ও সময়ের ভিত্তিতে যখন যেসব বইয়ের চাহিদা থাকে, সেসব বই সংগ্রহ করেন তিনি। সেগুলো নিয়ে ছুটে চলেন গ্রামগঞ্জ ও হাটবাজারে। বেশি বিক্রি হয় ‘বারো চাঁদের ফজিলত’, ‘নবীজির জীবনী’, ‘মা ফাতেমার জীবনী’, ‘নেয়ামুল কোরআন’, ‘শিশুদের সুন্দর নাম’, ‘কাজী নজরুলের সঞ্চিতা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘শরৎ–সমগ্র’, সমরেশ মজুমদারের বিভিন্ন উপন্যাস, হুমায়ূন আহমেদের হিমু, আনিসুল হকের ‘মা’, ‘খোয়াবনামা’, গানের চটি বই। এসব বই শরিফুল সংগ্রহ করেন রংপুর, সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, পার্বতীপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকার বুক স্টল থেকে।

সৈয়দপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, বইয়ের ফেরিওয়ালা প্রতিবন্ধী শরিফুল অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারেন অন্যরা। আর শরিফুলের এগিয়ে চলার পথে এ সমাজকে তাঁর পাশে থাকা দরকার।