বগুড়ায় ঝুলে গেল তিন সড়কের নির্মাণ ও সম্প্রসারণকাজ

সড়কে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। ইট দিয়ে সেসব স্থান সংস্কার হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর বগুড়া-নাটোর সড়কের নন্দীগ্রাম উপজেলার কাথম এলাকায়সোয়েল রানা

বগুড়ায় সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের তিনটি প্রকল্পে অর্থ ছাড় স্থগিত ও কর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি চলমান প্রকল্প মাঝপথে ঝুলে গেছে। বিল পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় ঠিকাদারেরা প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছেন। কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, তা নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্পের অর্থ ছাড় স্থগিত বা কর্তন করা হয়েছে। বগুড়ায় বরাদ্দ স্থগিত করা ‘সি’ ক্যাটাগরির দুটি প্রকল্প হলো বগুড়া-নাটোর মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ বা চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প এবং বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। অন্যদিকে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ কর্তন করা ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পটি হলো বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের ওমরপুর থেকে তালোড়া-দুপচাঁচিয়া হয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণ। এর মধ্যে বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও তালোড়া-দুপচাঁচিয়া হয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প দুটি প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার প্রকল্প।

এদিকে বগুড়া-নাটোর মহাসড়ক এবং ওমরপুর-দুপচাঁচিয়া-আক্কেলপুর সড়কে কাজ বন্ধ রাখায় চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পথচারী, গাড়িচালক ও যাত্রীদের। পণ্য পরিবহনও বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে বগুড়া-নাটোর মহাসড়ক বেহাল হয়ে পড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ছে গাড়ি। তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট।

বেহাল সড়ক ইট দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। ৭ সেপ্টেম্বর বগুড়া-নাটোর সড়কের নন্দীগ্রাম উপজেলার কাথম এলাকায়
সোয়েল রানা

খানাখন্দে বিকল গাড়ি

সড়ক ও জনপথ বিভাগ বগুড়ার নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বগুড়া-নাটোর জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ত উন্নীতকরণ (৪ লেনে উন্নীতকরণ) প্রকল্পে ৭০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সড়কের বগুড়া অংশে ৩২ কিলোমিটার সম্প্রসারণ ব্যয় হবে ৩১০ কোটি টাকা। বর্তমানে সড়কের প্রস্থ ১৮ ফুট। চলমান প্রকল্পে মূল মহাসড়ক ২৪ ফুটে উন্নীতকরণ ছাড়াও দুই পাশে ৫ ফুট করে আরও ১০ ফুট মহাসড়ক (গ্রামীণ লেন) সম্প্রসারণ করা হবে। এ প্রকল্পে সম্প্রতি রানা বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান তিনটি প্যাকেজ ও মেসার্স হাবিবুল আলম সাতটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা।
কিন্তু গত মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সি ক্যাটাগরির সব প্রকল্পের অর্থ ছাড় স্থগিত করা হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কের সম্প্রসারণকাজ আটকে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়ার শাকপালা থেকে নন্দীগ্রামের রনবাঘা বাজার পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এ মহাসড়কে রাতদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। গেল বর্ষাকাল শুরু হওয়ার পর থেকেই খানাখন্দে প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ছে নানা যানবাহন। বিশেষ করে পঞ্চগড় থেকে বড় বড় ট্রাকে পাথর বহন করা হচ্ছে পদ্মা সেতুসহ দক্ষিণের নানা প্রকল্প এলাকায়। এসব ট্রাক গর্তে আটকা পড়ায় যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানতে চাইলে সওজ বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জমান প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম দিকে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়। ঠিকাদারেরা সাইট বুঝেও নিয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বরাদ্দের অর্থ ছাড় স্থগিত করায় ঠিকাদারেরা গা–ছাড়াভাবে কাজ করছেন। আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

করোনাভাইরাসের কারণে বরাদ্দের অর্থ ছাড় স্থগিত করায় ঠিকাদারেরা গা–ছাড়াভাবে কাজ করছেন। আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আশরাফুজ্জমান, নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজের বগুড়া কার্যালয়

সংযোগ সড়ক নির্মাণে অনিশ্চয়তা

১৬ বছর আগে বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল সাকল্যে ১৩ কোটি ৭০ লাখ। তখন সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৬০ ফুট। এখন সড়কের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার ও প্রস্থ ২০ মিটার। কিন্তু নির্মাণ ব্যয় ঠেকেছে ১৯৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮১০ মিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। এখন নতুন করে ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়কের জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আরও ৬৫০ মিটার সড়কের জায়গা অধিগ্রহণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা। আর ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় হবে ১৮ কোটি টাকা। চলমান এ প্রকল্পে অর্থ ছাড় স্থগিত করায় ২০০৪ সালে হাতে নেওয়া সওজের এ প্রকল্প আবার ঝুলে গেছে।
এ সম্পর্কে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এ প্রকল্পে অর্থ ছাড় স্থগিতের কারণে আবারও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। অধিগ্রহণের ৯৯ কোটি, নির্মাণের ১৮ কোটিসহ এখনো অর্থ দরকার ১২০ কোটি টাকার ওপর। কিন্তু প্রকল্পে যে অর্থ ছাড় করা হয়েছে, তাতে এখন ২৯ কোটি টাকার মতো রয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগও হয়েছে। এখন অধিগ্রহণের ৯৯ কোটি অর্থের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে পানি জমে। দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। আজ সোমবার দুপচাঁচিয়া উপজেলার পলিপাড়া গ্রামে
প্রথম আলো

বেহাল সড়কে ভোগান্তি

বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের ওমরপুর থেকে তালোড়া-দুপচাঁচিয়া হয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পে বরাদ্দ মিলেছে ১০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর ৩০ কোটি টাকার অর্থ ছাড় করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বি ক্যাটাগরির এ প্রকল্পে ছাড় করা অর্থ থেকে ৩০ শতাংশ বা ৯ কোটি টাকা কর্তন করা হয়েছে। এতে ঠিকাদারের কাজ চলছে ধীরগতিতে।
মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ওমরপুর থেকে তালোড়া হয়ে দুপচাঁচিয়া পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটারের সংস্কারকাজ পেয়েছে মেসার্স মোজাহার এন্টারপ্রাইজ এবং ১৭ কিলোমিটার কাজ পেয়েছে মেসার্স আমিনুল হক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২ জানুয়ারি দেওয়া কার্যাদেশ মোতাবেক আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ করার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্যাদেশ পেয়ে এ সড়কের পিচ, পাথর ও খোয়া কার্পেটিং তুলে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। কিন্তু মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমে এ পথে চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বেহাল সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে পণ্যবোঝাই ট্রাক, ভটভটি, অটোরিকশা, ইজিবাইক ও রিকশা ভ্যান।