বগুড়ায় বাতাসে ‘প্রাণ যায় যায়’

বগুড়া জেলার মানচিত্র

বগুড়া শহরে সকালে হাঁটতে বের হলে রাস্তার ধুলাবালু, ইটের গুঁড়া, কলকারখানার কালো ধোঁয়ার কারণে দম নেওয়া দায়। যেন কালো ধোঁয়ার শহর। বলছিলেন বগুড়ার প্রবীণ শিক্ষক বজলুল করিম (৭৬)। বজলুল করিমের মতোই বললেন শিক্ষাবিদ ও লেখক শোয়েব শাহরিয়ার (৬৬)। তাঁর কথা, শহরের বাতাস এখন বিষ, ধুলাবালুতে ভরা, দুর্গন্ধযুক্ত। এ বাতাসে প্রাণ যায় যায়।

বগুড়া শহরের বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলি ও বস্তুকণা বেড়ে যাওয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর প্রমাণ মেলে যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বায়ুর মান সূচকে (একিউআই)। নিয়মিত বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আইকিউ এয়ারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় বগুড়া শহরের বায়ুর মান সূচক ছিল ১৫১। দূষণ ছিল ২ দশমিক ৫ পিএম। বায়ুর এই মান অনুযায়ী বগুড়া শহর ‘অস্বাস্থ্যকর’।

বগুড়ায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে শহরের প্রতিদিনের বায়ুর মান সূচক পর্যবেক্ষণের জন্য কন্টিনিউয়াস এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হয়। সেখানেই প্রতিদিনের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যালয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বায়ুর মান সূচকের মাত্রা ৫০ পর্যন্ত হলে স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের অবস্থান ‘ভালো’, ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত হলে ‘মধ্যম’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত হলে ‘সাবধান’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০০–এর ওপর হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি বগুড়া শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ। এদিন বায়ুর মান সূচক ছিল ৩২৮।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এদিন বগুড়া শহর ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ ক্যাটাগরিতে। চলমান শুষ্ক মৌসুমে এটা আরও বাড়তে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের রেকর্ড বলছে, গত বছরের ১৪ জানুয়ারি বগুড়া শহরের বায়ুর মান সূচক ছিল ২৪৪। এই মান অনুযায়ী বগুড়ার অবস্থান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ক্যাটাগরিতে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময়ে বায়ুর মানের উন্নতি হয়। ২৬ এপ্রিল বগুড়ার বায়ুর মান সূচক ছিল ১৩৮, অর্থাৎ ‘সাবধান’ পর্যায়ে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের রসায়নবিদ মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি শহরের প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা হয় বায়ুর মান সূচক। বাতাস কতটুকু বিশুদ্ধ বা দূষিত, সে সম্পর্কে তথ্য দেয় এই সূচক। সেই সঙ্গে ওই মাত্রায় কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে, তা জানা যায় এই সূচকে। বগুড়া শহরের বায়ুর মান সূচক ৩০০ ছাড়িয়েছে। যেখানে ২০১ হলেই স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ এই পরিস্থিতিকে জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ মাত্রায়ই শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়।

বগুড়ায় বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ার নানা কারণ দেখেন শহরবাসী। তাঁদের মতে, বায়ুদূষণের নেপথ্যে আছে শহর এলাকায় ইটভাটার কার্যক্রম, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ইট ভাঙা, শহরে বালু ও মাটিবাহী যানবাহনের বিচরণ, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো নানা বিষয়। প্রবীণ শিক্ষক বজলুল করিম বলেন, ‘এই দূষণের কারণে এখন বগুড়ায় নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ নেই। শহর ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযান আবারও শুরু করা হবে। পৌরসভা, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে বায়ুদূষণ ঠেকানো সম্ভব। শিল্পকারখানার দূষণ রোধে বাধ্যতামূলকভাবে ইটিপি চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইটভাটার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে শিক্ষাবিদ ও লেখক শোয়েব শাহরিয়ারের অভিযোগ, এত ধুলাবালু, অথচ একটু পানি ছিটানোর লোক নেই, গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কারও কোনো উদ্যোগ নেই।
বগুড়া পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ আল মেহেদী হাসান বলেন, ‘তরল বর্জ্য অপসারণের জন্য ভ্যাকুয়াম কনটেইনার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। শহরের রাস্তায় খোয়া-বালু অপসারণে মাঝেমধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফুজ্জামান বলেন, বগুড়ায় হালকা-মাঝারি এবং বড় শিল্পকারখানা আছে। পৌরসভার নর্দমার তরল বর্জ্য, নির্মাণ উপকরণ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা হয় সড়কের পাশে। বগুড়া শহরের চারপাশে ৩০টি ইটভাটা আছে। বায়ুদূষণের জন্য এ সবকিছুই দায়ী।