বগুড়ায় মাদ্রাসাশিক্ষককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা

দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত মাদ্রাসাশিক্ষক মোজাফফর হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

বগুড়ায় মাদ্রাসাশিক্ষক মোজাফফর হোসেনকে (৫৫) গুলি করে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পর তাঁর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে আজ বুধবার দুপুরে শাজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলাটি করেছেন। বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। কারা, কী কারণে মোজাফফরকে হত্যা করেছে, সেটা এখনো অজানা। হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন অস্ত্রচালনায় পারদর্শী পেশাদার দুজন কিলার। অন্য যাত্রীদের মধ্য থেকে মোজাফফরকে টার্গেট করে পরপর ছয়-সাতটি গুলি করা হয়েছে। প্রতিটি গুলি তাঁর বুকে ও আশপাশে ভেদ করেছে। পেশাদার কিলার ছাড়া এভাবে টার্গেট করে হত্যা করা সম্ভব নয়। আপাতত কয়েকটি কারণকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন

ফয়সাল মাহমুদ আরও বলেন, মোজাফফর বগুড়া শহরে নিশিন্দারা এলাকায় একটি কওমি মাদ্রাসা পরিচালনা ছাড়াও জিন–ভূত তাড়ানো, বশীকরণের কাজ করতেন। মানুষের ভাগ্যগণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দিতেন। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য মেটানো, সম্পর্ক ভাঙা-গড়া, নারীকে বশীকরণ, মন জয়ে তাবিজ–কবজকরণ, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা জাহির করতেন। এ জন্য ‘বাবা হুজুর’ হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। তাঁর ফোন কলের লিস্ট সংগ্রহ করে দেখা গেছে, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে ক্যাডার-সন্ত্রাসীরও। তাঁর সঙ্গে অনেকের ওঠাবসাও ছিল। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের কারণে কারও বিরাগভাজন বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন কি না এবং সেই ক্ষোভ থেকে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

নিহত মোজাফফর বগুড়া শহরে নিশিন্দারা এলাকায় একটি কওমি মাদ্রাসা পরিচালনা ছাড়াও জিন–ভূত তাড়ানো, বশীকরণের কাজ করতেন। মানুষের ভাগ্যগণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দিতেন। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য মেটানো, সম্পর্ক ভাঙা-গড়া, নারীকে বশীকরণ, মন জয়ে তাবিজ–কবজকরণ, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা জাহির করতেন। এ জন্য ‘বাবা হুজুর’ হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, মোজাফফর কখন, কোন অটোরিকশায় বগুড়া আসছেন, আগে থেকেই সেই তথ্য জানা ছিল খুনিদের। এ কাজে মোজাফফরের ঘনিষ্ঠ কাউকে অনুচর হিসেবে ব্যবহার করেছে খুনিরা। এ কারণে মৃত্যুর আগে সর্বশেষ কার কার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তা শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ফোন কলটি ছিল তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহচরের। ঘটনার পর থেকেই তাঁকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্য যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

বাদীর দাবি, পরিবারে সুসম্পর্ক ছিল মোজাফফরের

নিহত মোজাফফর হোসেনের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার সুকাশ ইউনিয়নের সুকাশ নওদাপাড়া গ্রামে। তবে তিনি বগুড়া শহরের কারবালা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি শহরের নিশিন্দারা এলাকায় দারুল হেদায়া কওমি হাফেজিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম বা পরিচালক ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার জোড়া কৃষি কলেজসংলগ্ন এলাকায় অস্ত্রের মুখে সিএনজিচালিত অটোরিকশার পথ রোধ করে দুর্বৃত্তরা। ওই অটোরিকশায় মাদ্রাসাশিক্ষক মোজাফফর হোসেন যাত্রী ছিলেন। এরপর প্রকাশ্য দিবালোকে মোজাফফর হোসেনের বুকে পরপর ছয়টি গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের বীরগ্রাম এলাকায় বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের এই স্থানে প্রকাশ্য গুলি করে মোজাফফর নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষককে খুন করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঘটনার পর ঘটনাস্থলে পুলিশের সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

মামলার বাদী সাইফুল ইসলাম আজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মোজফফর খুবই অমায়িক প্রকৃতির ছিলেন। এলাকায় তাঁর সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ নেই। অনেক আগে জায়গাজমি নিয়ে একজনের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও এখন তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

সাইফুল বলেন, ২০ বছর আগে তাঁর ভাই বগুড়া শহরে গিয়ে থিতু হন। সেখানে মাহফুজা আকতার নামের এক নারীকে দ্বিতীয় বিয়ে করে তিনি কারবালা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। এতে বড় স্ত্রী আসমা বেগম কোনো আপত্তিও করেননি। দুই স্ত্রীকেই সমানভাবে ভালোবাসতেন তিনি। নিজে বগুড়া শহরের নিশিন্দারা এলাকায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদ্রাসার সবকিছু দেখাশোনা করতেন মাহবুব সরকার নামের একজন শিক্ষক। তাঁকে খুব বিশ্বাস করতেন। সবকিছুই তাঁর সঙ্গে আলাপ করতেন। জিন-ভূত তাড়ানো, ভাগ্যগণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া, জাদুটোনা থেকে শুরু করে সব কাজেই সঙ্গী ছিলেন মাহবুব। মাদ্রাসা ও তাবিজ–কবজের আয়ে বাড়িতে সাড়ে চার বিঘা আবাদি জমি কিনেছেন তিনি। সংসার দেখাশোনা করার জন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়ে রুবেল নামের একজনকে ঘরজামাই রেখেছেন।

সাইফুল আরও বলেন, ‘বাড়িতে বোরো কাটা–মাড়াইয়ের জন্য গত ২৮ এপ্রিল তাঁর ভাই বগুড়া থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন। এই এক সপ্তাহে অচেনা কোনো ব্যক্তি বাড়িতে আসেননি। মাদ্রাসায় ঈদে জাকাত-ফিতরা আদায়ের জন্য বুধবার সকালে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা দেন। বগুড়ায় রওনা দেওয়ার বিষয়টি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর ও মাদ্রাসার আরেক শিক্ষক মাহবুব সরকার ছাড়া অন্য কারও জানার কথা নয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বগুড়া শহরের শাকপালা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার আগেই অটোরিকশার পথ আটকে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বসে থাকা আমার ভাইয়ের বুকে পরপর ছয়টি গুলি করে সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।’

বগুড়ার নিশিন্দারা দারুল হেদায়া কওমি হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাহবুব সরকারের মুঠোফোন বুধবার খোলা থাকলেও একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। তবে মঙ্গলবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোজাফফর মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কারও কোনো বিরোধ ছিল না। পারিবারিকভাবেও কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা ছিল না। মাঝেমধ্যে তিনি জিন-ভূত তাড়ানোর চিকিৎসা করতে যেতেন, ভাগ্যগণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দিতেন। তবে রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি এসব কাজ করেননি। কারও সঙ্গে কোনো বিরোধেও জড়াননি। কারা, কী কারণে তাঁকে এভাবে হত্যা করল, সেটা তিনিও বুঝতে পারছেন না।