বঙ্গীয় রেনেসাঁর কৃতী সন্তান

নবজাগরণের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এসে নিজেই বাংলার নবজাগরণে রাখলেন অনবদ্য অবদান। আদি ভারতীয় দর্শন রচনায় রাখলেন পথিকৃতের ভূমিকা

বেণীমাধব বড়ুয়া

বাংলার রেনেসাঁসের তথা নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে নতুন নতুন সৃষ্টিতে বাংলায় তখন এক নবচৈতন্যের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। মনন-সৃজনশীল প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী এই নবচিন্তায় উজ্জীবিত রেনেসাঁসের কৃতী সন্তানেরা বিজ্ঞান-দর্শন, ভূগোল-গণিত, সাহিত্য-শিল্পকলাচর্চার পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার শিকড় সন্ধানেও আত্মনিবেদিত ছিলেন, আবিষ্কারের তাগিদে অতীত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন। গৌরবোজ্জ্বল অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, গর্বিত উত্তরাধিকারী হিসেবে অতীতের ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিজীবনে সমাজজীবনের ইহলোককে সব ধরনের মানবিক চেতনায় ঋদ্ধ করা, সমৃদ্ধ করা, বিকশিত করাই ছিল রেনেসাঁসের সন্তানদের নিরন্তর সাধনা প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য।

বাংলার রেনেসাঁসের সূতিকাগার কলকাতা থেকে সুদূর চট্টগ্রামের এক নিভৃত অথচ অগ্রসর বৌদ্ধপল্লি হচ্ছে রাউজান থানার মহামুনি পাহাড়তলী গ্রাম। এ গ্রামে বাংলা নবজাগরণের এই সুবর্ণ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে কবিরাজ রাজ চন্দ্র তালুকদার ও ধনেশ্বরী দেবীর ঘর আলোকিত করে ১৮৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুভক্ষণে জন্ম নিল এক শিশু। এই শিশু পরবর্তীকালে নবজাগরণের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এসে নিজেই বাংলার নবজাগরণে রাখলেন অনবদ্য অবদান। আদি ভারতীয় দর্শন রচনায় রাখলেন পথিকৃতের ভূমিকা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধান-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুগপৎ প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক হিসেবে রাখলেন কৃতিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষার্থীদের অন্তরে শিক্ষার-জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশিয়ার প্রথম ডিলিট ডিগ্রিধারী ভারত-বাংলার কৃতী সন্তান বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত আচার্য ড. বেণীমাধব বড়ুয়া। ড. বি এম বড়ুয়া আমৃত্যু আরাম-আয়েশকে উপেক্ষা করে গবেষণা, জ্ঞানসাধনাকে জীবনের ব্রত করেছিলেন। লাভ করেছিলেন একাডেমিক কাজের মধ্য দিয়ে ভারততত্ত্ববিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, পালি ভাষা-সাহিত্যবিশারদ, বৌদ্ধ তত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ হিসেবে দেশ-বিদেশের প্রশংসা ও খ্যাতি। নিরন্তর বিদ্যাচর্চায় আর অগাধ পাণ্ডিত্যে তিনি শুধু বাংলা নয়, সর্বভারতীয় বিদ্বত্সমাজে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সর্বভারতীয়ও–বা বলি কেন, তিনি তাঁর প্রজ্ঞা-মেধায় বিশ্ববিশ্রুত মনীষীর খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সর্বভারতীয় কোনো বৌদ্ধই আজ পর্যন্ত পাণ্ডিত্যে তাঁর সমপর্যায়ে যেতে সক্ষম হননি বললে মনে হয় অপলাপ হবে না। শুধু একাডেমিক কাজে নিজেকে সদা নিয়োজিত রাখেননি, পাশাপাশি সামাজিক-সাংগঠনিক কাজেও সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমান নিবন্ধে তাঁর একাডেমিক ও সামাজিক-সাংগঠনিক কাজ এবং মানসচরিত্র অর্থাৎ জীবন ও কর্মকীর্তি ব্যাখ্যার আলোকে তাঁর মানবহিতৈষণা ও সমাজভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় তাঁর মেধা ও প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে, সাধারণ থেকে অসাধারণ ছাত্রে পরিণত হলেন। ১৯১৩ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে বেণীমাধব বিলেত গমন করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেণীমাধবের অধীত বিষয় পালি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর অথবা বৌদ্ধতত্ত্বের ওপর গবেষণাকর্মের বিষয় নির্ধারিত না হয়ে হলো ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর। গবেষণার বিষয় হলো: Indian Philosophy: Its Origin and Growth from Vedas to the Buddha. খুবই জটিল, কঠিন ও শ্রমসাধ্য এ গবেষণাকর্ম করার মনঃস্থির করে শুরুতেই বেণীমাধব অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিলেন। ১৯১৭ সালের ১৮ জুলাই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত শিক্ষকমণ্ডলী তাঁর গবেষণাকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করেন।

বিলেত থেকে ডিলিট ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে আসার পর ড. বেণীমাধব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি বিবেচনায় তাঁকে একই সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগে ও সংস্কৃত বিভাগেও খণ্ডকালীন অধ্যাপনায় নিযুক্ত করা হয়। একসঙ্গে এই তিন বিভাগে অধ্যাপনা করে গেছেন। তিনি ১৯২৫ সালে ১ জুন University Professor এবং ১৯৩০ সালে নতুন সৃষ্ট University Professor of Pali পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ মার্চ মৃত্যুদিবস পর্যন্ত তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত থেকে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে গেছেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে বেণীমাধব (সামনের সারিতে বাম থেকে তৃতীয়)
সংগৃহীত

প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিলালিপি, ভাস্কর্য, প্রত্নতত্ত্ব এবং বৌদ্ধতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর নিরন্তর জ্ঞানচর্চায় ও মৌলিক গবেষণায় রচিত ইংরেজিতে ১৮টি গ্রন্থ, বাংলায় ৭টি গ্রন্থ, গবেষণাধর্মী পত্রিকায় প্রকাশিত ইংরেজিতে ৮৬টি প্রবন্ধ ও বাংলায় ২২টি প্রবন্ধ বেণীমাধব বড়ুয়াকে বিশ্ব সারস্বতসমাজের কাছে এনে দিয়েছে একই সঙ্গে ভারততত্ত্ববিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ এবং ঐতিহাসিকের পরিচিতি।

১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর A History of Pre-Buddhistic Indian Philosophy গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের আকর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত, এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি দেশ-বিদেশের পণ্ডিত সমাজ কর্তৃক দর্শন শাস্ত্রবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মূলত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর গবেষণাকর্মটির নতুন নামকরণে সংশোধিত ও পরিবর্ধিত রূপে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে প্রাচীন ভারতের বেদ, সংহিতা, আরণ্যক, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পালি ও প্রাকৃত সাহিত্য, সমসাময়িক গ্রিক ইতিহাস-দর্শন ইত্যাদি অধ্যয়ন-বিশ্লেষণপূর্বক তিনি প্রাক্‌–বৌদ্ধ আদি ভারতীয় দর্শনের ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেন। বইটি সম্পর্কে তাঁর ছাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত রিডার অধ্যাপক সুকুমার সেনগুপ্তের অভিমত হচ্ছে, ‘ভারতীয় দর্শনের আদি যুগের ইতিবৃত্ত রচনার দিক থেকে বেণীমাধবকেই পথিকৃৎ বলে গণ্য করা যায়। ড. বড়ুয়ার পূর্বে কোনো ভারতীয় পণ্ডিতের পক্ষে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে নাই।’

প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৮৫-১৯৩০) অধ্যাপনা গুণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় ছাত্র বেণীমাধবের অন্তরে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে যে আগ্রহ-কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে অধ্যাপনাকালে শতধারায় বিকশিত হয়েছিল। প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান-নিদর্শনের বর্ণনা, শিলালিপির পাঠোদ্ধার, শিলা চিত্র ব্যাখ্যা ও গবেষণার ভিত্তিতে ড. বড়ুয়া রচনা করেন Barhut Inscription (কুমার গঙ্গানন্দ সিংহের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত ও অনূদিত, ১৯২৬), Old Brahmi Inscription in the Udayagiri and Khandagiri Caves (1926), Asoka Edicts in New Light (1926), Gaya and Buddhagaya (Volume I, 1931 & Volume II, 1934), Barhut (Volume I, II, & III, 1934-37), Inscription of Asoka (1946) ইত্যাদি প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ। গ্রন্থগুলোকে প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক কোষধর্মী গ্রন্থ বললে অত্যুক্তি হয় না। গ্রন্থগুলো প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ে ড. বেণীমাধবের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের ও মৌলিক গবেষণার স্বাক্ষর বহন করে। ড. বড়ুয়া অশোক শিলালিপি, বরহুত শিলালিপি, বুদ্ধগয়া শিলালিপিসহ প্রত্নতত্ত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপূর্বক প্রাচ্য-পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্ববিশারদদের বক্তব্যে ভুল থাকলে ভিন্নমত থাকলে তা পরিবর্তন পরিমার্জন করে যুক্তিসহকারে নিজস্ব নতুন মত প্রকাশ করেন—এখানেই প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর বিশেষত্ব।

তাঁর খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান আসতে থাকে। ১৯৪৪ সালে শ্রীলঙ্কার ডোনা এলপাইন রতনায়কে ট্রাস্ট ও সিলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বুড্ডিস্ট ব্রাদারহুডের যুগ্ম আমন্ত্রণে সিংহল দ্বীপ গমন করে ৮টি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাগুলো নিয়ে ১৯৪৫ সালে Ceylon Lectures নামে একটা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, লেকচারগুলোতে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে শ্রীলঙ্কার অবদান, শ্রীলঙ্কার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, বাংলার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক, বৌদ্ধধর্ম-দর্শনের বিভিন্ন দিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিধৃত হয়েছে। এ সময় বৌদ্ধশাস্ত্রে পালি ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার পরিবেশ (বর্তমানে বিদ্যালংকার বিশ্ববিদ্যালয়) বেণীমাধবকে ‘ত্রিপিটকাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

মানুষ হিসেবে শিক্ষাবিদ হিসেবে ড. বড়ুয়া অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। পরহিতব্রতী বেণীমাধব বড়ুয়া নিজের ক্ষতি করে হলেও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সব সময় সচেষ্ট থাকতেন। ছোটখাটো শীর্ণকায়ের মানুষটির অন্তর ছিল বিশাল। সাহায্য–সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশায় কেহ তাঁর কাছে গেলে বঞ্চিত হতো না। অসীম ঔদার্যের সঙ্গে আর্থিক অথবা কায়িক-মানসিক-বাচনিক সহায়তা প্রদান করতেন। যার কারণে জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি ছাড়াও নানান শ্রেণির চরিত্রের লোক তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় নিজ উদ্যোগে কলকাতা থেকে ত্রাণসামগ্রী এনে চট্টগ্রামে বিতরণ করেন। উদার হৃদয়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। অন্তর্গত ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ পেত। ড. বড়ুয়া তাঁর মৃত মায়ের পারলৌকিক সদ্‌গতি কামনার জন্য মসজিদ, মন্দির, চার্চসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দান দিয়েছিলেন। এবং বড় মেয়ের বিয়েতে বিয়ের মন্ত্র পাঠের জন্য পাদরি, মোল্লা, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু সবাইকে একত্র করেছিলেন।

বেণীমাধব বড়ুয়ার লেখা চিঠি
সংগৃহীত

তাঁর অন্তরজুড়ে ছিল ছাত্রছাত্রীদের জন্য অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের রিডার বেণীমাধবের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী ড. সুধা সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণায় তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এভাবে, ‘মাস মাহিনা দেওয়ার ফি বুক উনি নিজের কাছেই রেখে দিলেন, আমাকে আর কোনো দিন ফি দিতে হয়নি। পরে মৃত্যুর পর ওঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার ফি বুক বেরোল, উনি প্রতি মাসে আমার ফি জমা করে গেছেন।... মৃত্যুর দিনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মিটিং করে গেছেন, অর্ধ রাত্রেরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, প্রভাত হওয়ার আগেই তাঁর জীবন-রবিও অস্তমিত হয়ে গেল। আমি খবর পেলাম প্রভাতের সংবাদপত্র মারফত। আজীবন পিতৃস্নেহ বঞ্চিতা একটি মেয়ে আবার পিতৃহীন হয়ে গেল।’

ড. বেণীমাধব বড়ুয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন-কমিটির সঙ্গে যেমন সম্পৃক্ত ছিলেন, তেমনি জনহিতকর সমাজ ধর্ম বিকাশমূলক বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠান, মানবসেবা-আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আপত্কালীন সংস্থা-কমিটির এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হয়ে কাজ করেছিলেন।

গবেষণামূলক ও সমাজসংস্কার-বিকাশমূলক নানা কার্যে ব্যস্ত থেকেও তিনি বিভিন্ন সময়ে জগজ্জ্যোতি, বিশ্ববাণী, Buddhist India, Indian Culture ইত্যাদি সাময়িকপত্র সম্পাদনা করে সম্পাদক হিসেবেও তাঁর যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

দুর্লভ মানবজীবনকে খুবই গুরুত্ব দিতেন বলে জ্ঞানচর্চায় অথবা সমাজসেবায় নিজেকে সর্বদা যুক্ত রাখতেন। তিনি মৃত্যুর দিনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছিলেন। সর্বদা একটা না একটা কাজে নিজেকে জড়িত রাখতেন। তাঁর জীবনদর্শনও ছিল জীবঘনিষ্ঠ জীবনবাদী, এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘জীবন, যৌবন এবং জাগরণে আমি বিশ্বাস করি। মৃত্যু, বার্ধক্য এবং নিদ্রায় আমার বিশ্বাস নাই। যেখানে জীবন, যৌবন এবং জাগরণকে ব্যাহত হইতে দেখি, সেখানেই আমি ব্যথিত হই। ইহাই বস্তুত আমার একমাত্র বক্তব্য।’

সমাজচিন্তক সমাজসেবী বেণীমাধব উন্নতি প্রয়াসী মানবের জীবনের লক্ষ্য আদর্শ কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর এক অভিভাষণে বলেন, ‘উন্নতি প্রয়াসী ও উন্নতিশীল মানবের ও মানব পরিবারের এই তিনটি কামনা হইতে পারে। আমি নিজে বড় হইব, আমি অপরকে বড় করিব, অথবা আমি নিজেও বড় হইব এবং অপরকেও বড় করিয়া তুলিব। এই তিন কামনার মধ্যে শেষোক্ত কামনাই সর্বশ্রেষ্ঠ কামনা। ইহাই বস্তুত উন্নতি প্রয়াসী, উদ্যমশীল ও উন্নতশীল মানবের ও মানব পরিবারের প্রকৃত আদর্শ।’

ড. বি এম বড়ুয়ার মনুষ্যত্ববোধসঞ্জাত জীবনঘনিষ্ঠ এই সব উপলব্ধি সর্বকালে সর্বমানবের জন্য চরম সত্য। ড. বড়ুয়া শেষোক্ত কামনা অনুসারে নিজের জীবনকেও পরিচালিত করেছিলেন। প্রত্যেকের জীবনদর্শন জীবনাদর্শ তাই হওয়া উচিত।

ড. বড়ুয়ার নিজের জীবনদর্শনে কোনো ধরনের অন্ধতা, কুসংস্কার, আত্মাভিমান ও গোঁড়ামির স্থান ছিল না। তিনি মনে করতেন কোনো কিছু না বুঝে যন্¿বত্ মন্¿উচ্চারণ করার চেয়ে জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে ধর্ম পালন করা অনেক শ্রেয়। ড. বড়ুয়া খুবই বাস্তববাদী ছিলেন। ভাববাদ-অধ্যাত্মবাদের চেয়ে নৈতিক ও আদর্শভিত্তিক জীবন গঠনের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ছিল।

নারী সমাজের প্রতি বেণীমাধবের শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল অপরিসীম। তাঁর মতে, Hyperbola সদৃশ সমাজ কাঠামোর একটি কেন্দ্র হচ্ছে নারী সমাজ। জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী, তাদের অবহেলা করে অন্ধকারে রেখে দেশ-সমাজ-সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁর দৃষ্টিতে নারী সমাজ চরিত্র গঠনে, সমাজ গঠনে, পরিচালনায় এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক গৌরবজনক স্থানে অধিষ্ঠিত।

আচার্য ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার বর্ণাঢ্য ও সফল কর্মজীবন, উঁচু জীবনাদর্শ জীবনদর্শন, তাঁর আদি ভারতীয় দর্শন-প্রত্নতত্ত্ব-ভারততত্ত্ব-বৌদ্ধতত্ত্ববিষয়ক গবেষণামূলক রচনাবলি, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নমূলক বক্তব্য-ভাষণ ও সমাজকর্মে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য প্রোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। সংকটে-দুর্দিনে ভেঙে পড়ার মুহূর্তে জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-সমাজ এখান থেকে খুঁজে পাবে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি, অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা।

শিমুল বড়ুয়া: অধ্যক্ষ, লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ, কুমিরা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-গবেষক।