বছরের মাঝামাঝি সময়ে নীতিমালা ভেঙে ভর্তি

নীতিমালা ভেঙে ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে বছরের মাঝামাঝি সময়ে ৩৪ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তি কমিটির সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান এর অনুমোদন দিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা সরকারি চাকরিজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির নীতিমালায় (সংশোধিত ২০২০) বদলিজনিত কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদের ভর্তির নিয়ম আছে। তবে সে জন্য আবেদন করতে হবে বদলির ছয় মাসের মধ্যে। নতুন ভর্তি হওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানের বেলায় সে নিয়ম মানা হয়নি।

আর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ ব্যক্তির সন্তানদের এভাবে ভর্তির কোনো নিয়মই নেই। বদলি হওয়া সরকারি কর্মকর্তার সন্তানকে ভর্তির বিষয়েও নীতিমালায় ব্যাখ্যা আছে। এতে বলা হয়েছে, যে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে ইচ্ছুক, সেখানে আসন ফাঁকা থাকতে হবে। আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না।

কিন্তু সরকারি বালক ও বালিকা বিদ্যালয়ে আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী হিসেবে ওই ৩৪ জনকে ভর্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তার সন্তান ১৪ জন, যাদের মধ্যে ৯ জনের অভিভাবক ছয় মাসের বেশি সময় আগে বদলি হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছেন। ব্যবসায়ীর সন্তান ১৩ ও রাজনীতিবিদের সন্তান ৭ জন।

ভর্তির সুপারিশে স্বাক্ষর করা জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান বিসিএস একাডেমির পরিচালক পদে বদলি হয়েছেন। ভর্তির সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, সামগ্রিক কথা চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিয়ম না থাকলেও এলাকার নীতিনির্ধারক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের চাহিদার কারণে এ সময়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। শুধু এ জেলায় নয়, দেশের সবখানেই এমনটা ঘটে।

জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নিজেদের সন্তানকে ভর্তি করার জন্য ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় ৭২ ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ৭৮টি আবেদন জমা পড়ে। ৩ জুন ভর্তি কমিটির এক সভা ডাকেন জেলা প্রশাসক। সেখানে কার্যবিবরণীর মাধ্যমে ভর্তির তালিকা তৈরি করে সদস্যদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ১০ জুন শিক্ষার্থী ভর্তির সুপারিশ পেয়ে ১২ জুন ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ১৩ জন ও বালিকা বিদ্যালয়ে ২১ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুপারিশ করেছে কমিটি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ১১ জন, বালিকা বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর নামে দুবার সুপারিশ হওয়ায় সেখানে একটি আসন কমে গেছে।

সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পীযূষকান্তি রায় বলেন, আসন শূন্য না থাকলেও জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর করা কার্যবিবরণী পেয়ে ছাত্র ভর্তি করিয়েছেন। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাননি তিনি।

বদলির অনিয়ম

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্প্রতি বদলি হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের কথা বলা হয়েছে। তবে ঠাকুরগাঁও জেলা তথ্য বাতায়ন ঘেঁটে দেখা গেছে, ৯ কর্মকর্তা ৬ মাসের বেশি সময় আগেই কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছেন। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মোস্তাক আহম্মেদ ও ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সহকারী রশিদুল ইসলাম কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন। ৩ জুনের সভায় তাঁদের সন্তানদেরও ভর্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, তিনি আগে বদলি হলেও পরিবারের সদস্যরা টাঙ্গাইলে ছিলেন। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে এসেছেন। ছয় মাসের মধ্যে আবেদনের নীতিমালার বিষয়ে তিনি জানতেন না।

বঞ্চিতদের অভিযোগ

বিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা না থাকায় আবেদন করে সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেননি জেলা শহরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার তাফাছুর রহমানের এক মেয়ে এবার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সহোদর কোটায় তিনি অপর মেয়েকেও একই বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করলে তা সুপারিশ করা হয়। একইভাবে ঠাকুরগাঁও শহরের গোয়ালপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ তাঁর এক ছেলেকে সহোদর কোটায় ভর্তির আবেদন করলে আসন ফাঁকা না থাকার কথা বলে আবেদনটি বাতিল করে ভর্তি কমিটি। একই অভিযোগ করেন শহরের বাসিন্দা সঞ্জীব কুমার বর্মণও।

চিকিৎসক স্বামীর বদলির কারণে ছেলের জন্য সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেছিলেন নিলুফার ইয়াসমিন। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, আর্থিক সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের চাপ না থাকলে জেলা প্রশাসক এভাবে অনিয়ম করে শিক্ষার্থী ভর্তির ঝুঁকি নেবেন কেন? তাঁর (নিলুফার) ছেলেকে ভর্তি করা না হলে তিনি প্রয়োজনে আদালতে যাবেন।

ঠাকুরগাঁও নাগরিক কমিটির সভাপতি আবু তোরাব মানিক বলেন, ভর্তির পরীক্ষার বাইরে অনিয়ম করে শিক্ষার্থীদের সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো একেবারেই অনৈতিক। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পাঁচ মাস পর গোপনে শিক্ষার্থী ভর্তির পেছনে কোনো আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কারণ থাকতে পারে।