মতামত না নিয়েই ড্রেন প্রকল্প, ২০০ গাছ কাটল সিটি করপোরেশন

বন বিভাগের পর্যবেক্ষণ ও মতামত নেওয়ার আগেই এক রাতে কেটে ফেলা হয়েছে ২০০ গাছ, যার দাম দেড় থেকে দুই কোটি টাকার কাছাকাছি। মঙ্গলবার সকালে সিলেট সিটির শাহজালাল উপশহর এলাকায়
ছবি : আনিস মাহমুদ

রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। রাস্তার একপাশে একটি ড্রেন (নালা) করতে অল্প কিছু গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ জন্য বন বিভাগকে একটি চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন। তবে চিঠির বন বিভাগের পর্যবেক্ষণ ও মতামত নেওয়ার আগেই এক রাতে কেটে ফেলা হয়েছে ২০০ গাছ, যার দাম দেড় থেকে দুই কোটি টাকার কাছাকাছি। গতকাল সোমবার সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।

আজ মঙ্গলবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তার পাশ থেকে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছ ফালি করে রাস্তার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু গাছের ফালি ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে ট্রাকে গাছ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো সিটি করপোরেশনের নয়। ট্রাকচালকদের মাধ্যমে জানা গেছে, গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত ছোট-বড় ২০০টি গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে বড় অকারের পরিপক্ব গাছ ১২৭টি ছিল। গাছের টুকরা কেনা হয়েছে জানিয়ে ট্রাকচালকেরা আর কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে গাছ কেটে অধিকাংশ বিক্রি করে ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি চক্র গাছ কেনাবেচায় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। খবর পেয়ে বন বিভাগের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে তদন্ত করে কেনাবেচার সত্যতা পেয়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জান গেছে, চলতি অর্থবছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেন নির্মাণ ও রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ শুরু হয়েছে। শাহজালাল উপশহর এলাকার সি ব্লকের ২১, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর রাস্তায় সম্প্রতি নালা ও রাস্তা বড় করার কাজ শুরু হয়। ওই এলাকার রাস্তার দুই পাশে রেইনট্রিসহ নানা প্রজাতির এসব গাছ ১৯৯০ সালের দিকে লাগানো হয়েছিল।

গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত ছোট-বড় ২০০টি গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে বড় অকারের পরিপক্ব গাছ ১২৭টি ছিল। একেকটি গাছ থেকে অন্তত এক লাখ টাকার কাঠ হবে। অথচ বন বিভাগ বলছে, বড়জোর ৫০টির মতো গাছ কাটতে হতো।

বন বিভাগের বিধিমালায় আছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন অথবা সরকারি জমি থেকে গাছ কাটার আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। এরপর তদন্ত করে গাছ টাকার যৌক্তিকতা পাওয়া গেলে গাছের দরদাম নির্ধারণ ও পরবর্তী আরও গাছ লাগানোর শর্তে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়া বন বিভাগের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বন বিভাগের সিলেট টাউন রেঞ্জার মো. শহীদুল্লাহ এই নীতিমালার বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপশহরে রাস্তার দুই পাশে ড্রেন নির্মাণ করতে কিছু গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ১৭ অক্টোবর বন বিভাগকে একটি চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন। পরদিন আমরা সেখানে গিয়ে দেখি গাছ কাটা হয়ে গেছে। এখন ঠিক কী পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে, কাটা গাছ কোথায় নেওয়া হয়েছে, এসব নির্ণয় করা কঠিন হয়ে গেছে।’

যোগাযোগ করলে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, বন বিভাগকে চিঠি দিয়ে আগ বাড়িয়ে সিটি করপোরেশনের কিছু লোক গাছ কেটে ফেলেছেন। তিনি দাবি করেন, একটি নালা নয়, সেখানে রাস্তা বড় করার প্রকল্প কাজ একসঙ্গে চলেছে। গাছ কাটার বিষয়ে আজ অবহিত হয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ড্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নে এভাবেই নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে শাহজালাল উপশহর এলাকায়
ছবি : আনিস মাহমুদ

কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো প্রকল্প বাস্তবায়নে গাছ রক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। উপশহরে গাছ কাটার বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। আর যাতে অকারণে কোনো গাছ কাটা না হয়, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াব।’

যদিও গাছ যেখানে কাটা হয়েছে, সেই এলাকায় ড্রেন নির্মাণ ছাড়া সড়ক প্রশস্তকরণের কোনো কাজ চোখে পড়েনি। সেখানে অবস্থানকালে দেখা গেছে, ২০০টি গাছ কাটার পরও আরও কিছু গাছ কাটতে করাত চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন কয়েকজন শ্রমিক। যেখানে ড্রেন হবে, সেখানে ছাড়াও গাছ কাটার প্রস্তুতি চলছে। গাছ কাটা ও কেনাবেচার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের কাজ বলে নীরব থাকেন শ্রমিকেরা। একই সময় বন বিভাগের দুজন কর্মীকেও সেখানে পাওয়া যায়। তাঁরা বলেন, সিটি করপোরেশন বিধি অনুযায়ী গাছ কাটেনি। বড়জোর ৫০টির মতো গাছ কাটতে হতো। সেখানে দুই শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে জানিয়ে বন বিভাগের একজন কর্মী বলেন, অধিকাংশই পরিপক্ব গাছ কাটা হয়েছে। একেকটি গাছ থেকে অন্তত এক লাখ টাকার কাঠ হবে।

শাহজালাল উপশহর সিলেট নগরীর প্রথম আবাসিক এলাকা। ১৯৭৮ সালে এই আবাসিক এলাকা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলেও উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব সিলেট সিটি করপোরেশনের। বাসিন্দারা বলেছেন, ১৯৯০ সালের দিকে বাসিন্দাদের ব্যক্তি উদ্যোগে গাছগুলো রোপণ করা হয়। রোপণ করা গাছগুলো পুরো আবাসিক এলাকার ছায়াঘেরা সবুজ পরিবেশ তৈরি করেছে।

গাছ রোপণে ব্যক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে উপশহরের বাসিন্দা আফতাব চৌধুরী ১৯৯৮ সালে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে জেলা বন, পরিবেশ ও জলবায়ু কমিটির একজন সদস্য। জানতে চাইলে আফতাব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাছগুলোর অধিকাংশ আমার হাতে লাগানো। কোনো বাছবিচার নেই, নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। যেখানে দুটো গাছ কাটলে হয়, সেখানে ২০টি কাটা হচ্ছে। কারা কাটছে, কেন কাটছে, কোনো জবাবদিহিও নেই। ২০০টি গাছ একেকটি এক লাখ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার মতো। সিটি করপোরেশনের একটি ড্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে গাছ কেটে কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে শুনেছি। আমি সিটি করপোরেশনকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। এ বিষয়টি এখন জেলা বন, পরিবেশ ও জলবায়ু কমিটির মাসিক সভায় উপস্থাপন করব।’