বন্দরে ‘পেঁয়াজ–জট’

জেটিতে ভেড়ানোর পর খালাসের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে পেঁয়াজের কনটেইনারবাহী ‘হ্যাপি বি’ নামের এই জাহাজটিকে। খালাসের আগে গত শনিবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে
ছবি:সংগৃহীত

ভারত রপ্তানি বন্ধের পর বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য হুড়মুড়িয়ে পড়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। ঘাটতি মেটাতে আমদানিতে উৎসাহও দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এখন একত্রে অনেক পেঁয়াজ দেশে চলে আসায় বাজারে দরপতন শুরু হয়েছে। লোকসানের ভয়ে ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পেঁয়াজ খালাসও কমিয়ে দিয়েছেন। বন্দরে শুরু হয়েছে পেঁয়াজ–জট।

চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে গতকাল সোমবার সকালে ভেড়ানোর অপেক্ষায় বহির্নোঙরে ছিল ৯টি কনটেইনার জাহাজ (সব ধরনের পণ্যবাহী)। এক সপ্তাহ আগেও সংখ্যাটি এক থেকে দুইয়ের মধ্যে ছিল। জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পেঁয়াজের কনটেইনার নামানোয় দেরি হওয়া।

আমদানিকারকেরা জানান, চীন, মিসর ও তুরস্কের মতো দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে। কনটেইনার খোলার পর পেঁয়াজ দ্রুত বিক্রি করতে না পারলে পচন ধরে। তাই আমদানিকারকেরা বিক্রি অথবা আড়তে তোলার নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই বন্দর থেকে পেঁয়াজ খালাস করেন। এখন বাজারে দাম কমে যাওয়ায় খালাসে অনাগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

গতকাল সকালের হিসাবে, বন্দর চত্বরে ১ হাজার ১০৪ একক কনটেইনারে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার টন পেঁয়াজ পড়ে ছিল। জেটি ও বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে নামানোর অপেক্ষায় ৭৬৪ কনটেইনারে ছিল আরও সাড়ে ১০ হাজার টন পেঁয়াজ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, হিমায়িত কনটেইনার রাখার জায়গা আর ফাঁকা নেই। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ খালাস না করলে বন্দরে জাহাজ–জট তৈরি হবে। এখন জাহাজ থেকে কনটেইনার নামাতেও সমস্যা হচ্ছে।

পেঁয়াজ খালাস না হওয়ায় জাহাজকে বন্দরে আটকে থাকতে হচ্ছে। যেমন, ‘হ্যাপি বি’ নামের একটি জাহাজে ৯৪ একক হিমায়িত কনটেইনারে পেঁয়াজ আমদানি হয়। জাহাজটি পেঁয়াজ নামাতে না পেরে নির্ধারিত সময়ে বন্দর ছাড়তে পারেনি। জাহাজটির স্থানীয় প্রতিনিধি ক্রাউন নেভিগেশনের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেদ সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজের জন্যই জাহাজটিকে এক দিন বাড়তি অবস্থান করতে হয়েছে।

লোকসানের ভয়

দিনাজপুরের হিলির মেসার্স রায়হান ট্রেডার্স ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান থেকে প্রায় তিন হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খুলেছিল, যার দেড় হাজার টন চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। গতকাল পর্যন্ত খালাসের অপেক্ষায় ছিল প্রায় ৬০০ টন।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানি করে এখন কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা করে লোকসান দিচ্ছি।’

পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গতকাল আমদানি করা মোটামুটি মানের পেঁয়াজ বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে। অঙ্কুরোদ্‌গম হওয়া পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন আমদানিমূল্যই ৩৯ টাকা।

লোকসানের কথা জানান খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক এটিআর ট্রেডিংয়ের মালিক নুরুল আলমও। তিনি দাবি করেন, চীন থেকে ১৪৫ টন পেঁয়াজ আমদানি করে তাঁর সাড়ে ৪২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এভাবে দরপতন হলে হিমায়িত কনটেইনার থেকে পেঁয়াজ খালাস করে রাখব কোথায়?’

আসছে বিপুল

ভারত গত ১৪ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে মোট ১ লাখ ৪০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়। অন্যদিকে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র ও কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, ভারত রপ্তানি বন্ধের পর থেকে গত রোববার পর্যন্ত প্রায় ৪৪ হাজার টন পেঁয়াজ খালাস করেছেন আমদানিকারকেরা। খালাসের অপেক্ষায় আরও ২৬ হাজার টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। আমদানি হয় আরও ১০ থেকে ১১ লাখ টন। পেঁয়াজ আসে মূলত ভারত থেকে। তবে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ঘাটতি মেটাতে বিকল্প উৎস খোঁজেন ব্যবসায়ীরা। চীন, মিসর, তুরস্কের মতো দেশ থেকে পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে জাহাজে ২২ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগে। হিমায়িত কনটেইনারে ছাড়া ওই সব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি সম্ভব নয়। তবে প্রায়ই দেখা যায়, আমদানির পর পেঁয়াজ পচে যায় এবং লোকসান দেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গুদাম নির্মাণ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে পণ্য নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচবেন।