বন্যার পানি কমছে, বেরিয়ে আসছে ক্ষত

বন্যার পানি সরে যাওয়ায় এখন ভেসে উঠছে সড়কের ক্ষত চিহ্ন। পানির স্রোতের চাপে খন পর্যন্ত বন্যায় উপজেলার ৩০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। আজ দুপুরে চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল সড়কে
ছবি: এস এম হানিফ

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভায় বন্যার পানি কমে গেছে। তবে এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে ৯টি ইউনিয়নের মানুষ। বিভিন্ন স্থানে পানি সরে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

আজ শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সিকদারপাড়ায় দেখা যায়, শিকলঘাট-কৈয়ারবিল পিচঢালা সড়কের অন্তত ছয়টি স্থান স্রোতের চাপে ভেঙে গেছে। স্থানীয় লোকজন গাছ দিয়ে সাঁকো তৈরি করে চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন। এখান থেকে কিছুটা পশ্চিমে কৈয়ারবিল স্টেশন। এই এলাকার বাড়িঘর এখনো পানিতে ডুবে আছে। তিন দিন ধরে পানি না কমায় অনেকে উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন।

বিএম চরের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ এখনো পানিতে ভাসছে। খুবই কষ্টে আছেন তারা। কিন্তু বন্যার্ত মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল। আরও বেশি বরাদ্দ দরকার।
জাহাঙ্গীর আলম, চেয়ারম্যান, বিএম চর ইউনিয়ন পরিষদ

স্থানীয় বাসিন্দা শফি আহমদ বলেন, ‘তিন দিন ধরে বাড়িঘর প্লাবিত হয়ে আছে। পানি কমার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে অর্ধাহারে–অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে আমার ছোট দুই সন্তানের সর্দি ও জ্বর দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে চকরিয়া পৌর শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে চলে যাচ্ছি।’

স্থানীয় ব্যবসায়ী আফজাল-উর রহমান চৌধুরী তিন দিন ধরে প্লাবিত এলাকার লোকজনকে খাবার বিতরণ করছেন। তিনি বলেন, অনেকের ঘরের চালা পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। অনেক মানুষ রান্না করতে না পেরে অনাহারে আছেন। এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার মানুষের জন্য বিরিয়ানি রান্না করেছেন বলে জানান তিনি।

উপজেলার ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে অবস্থিত ২৫২টি চিংড়িঘের প্লাবিত হয়েছে। এতে ১৯ কোটি ১২ লাখ টাকার ৩৮২ মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে গেছে।
বন্যার পানিতে সব ডুবে আছে। চলাচলে নৌকায় একমাত্র ভরসা। এখনো ৯টি ইউনিয়নের মানুষ এভাবে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।
ছবি: এস এম হানিফ

বিএম চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিএম চরের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ এখনো পানিতে ভাসছে। খুবই কষ্টে আছেন তারা। কিন্তু বন্যার্ত মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল। আরও বেশি বরাদ্দ দরকার।

এদিকে চকরিয়া পৌরসভা, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, হারবাং, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, বমুবিল ছড়ি, চিরিংগা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়ন থেকে পানি সরে যাওয়ায় গ্রামীণ ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠছে। এসব গ্রামের অনেকেরই কাঁচা বাড়িঘর ধসে পড়েছে

শুধু কৈয়ারবিল নয়, চকরিয়া উপজেলার বিএম চর, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, বদরখালী, কোনাখালী, সাহারবিল ও বরইতলী ইউনিয়নের মানুষ এখনো পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকটে দিন পার করছেন এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা।

স্লুইচগেটগুলো সব খুলে দেওয়ায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা আলীকদমে বৃষ্টি না হওয়ায় দ্রুত ৯টি ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার পানি সরে গেছে। অন্য ৯টি ইউনিয়নের পানিও কমতে শুরু করেছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী কমল কান্তি পাল প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার সব ইউনিয়ন থেকে এখন পর্যন্ত বন্যার পানি পুরোপুরি সরে যায়নি। এখন পর্যন্ত বন্যায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক দেবে বা ভেঙে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ প্রথম আলোকে বলেন, স্লুইচগেটগুলো সব খুলে দেওয়ায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা আলীকদমে বৃষ্টি না হওয়ায় দ্রুত ৯টি ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার পানি সরে গেছে। অন্য ৯টি ইউনিয়নের পানিও কমতে শুরু করেছে। বন্যার্তদের জন্য আরও ২৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত শুকনা খাবারও দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ভেসে গেছে ১৯ কোটি টাকার চিংড়ি

কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার আড়াই শতাধিক চিংড়িঘের ভেসে একাকার হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১৯ কোটি টাকার চিংড়ি ভেসে গেছে বলে জানা গেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার চিরিংগা, বদরখালী, সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী এলাকায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে আনুমানিক ৮১০টি চিংড়ির ঘের রয়েছে।

চিরিংগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চরণদ্বীপ ও সওদাগর ঘোনার অন্তত ৪৮টি চিংড়ির ঘের বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এসব ঘেরের মালিকদের এখন পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

চকরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে অবস্থিত ২৫২টি চিংড়িঘের প্লাবিত হয়েছে। এতে ১৯ কোটি ১২ লাখ টাকার ৩৮২ মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে গেছে। এ ছাড়া চকরিয়ার ৮২টি বাণিজ্যিক পুকুর বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার ৫৩ মেট্রিক টন সাদা মাছও ভেসে গেছে।