বন্যায় কৃষকের ক্ষতি এড়াবে ভাসমান বীজতলা

চলতি বছরের বীজতলার ক্ষতি পোষাতে নীলফামারী জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে এই বীজতলা তৈরি সম্ভব। বীজতলা যদি ভাসমান করা যায়, তাহলে বন্যার পানি উঠলেও ক্ষতি হবে না।

জলাশয়ে তৈরি ভাসমান বীজতলায় পানি ছিটাচ্ছেন এক কৃষক। সম্প্রতি নীলফামারী উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়নের অচিনতলা এলাকায়
প্রথম আলো

চলতি বছরের কয়েক দফার বন্যায় নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৬০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। তবে বন্যার স্থায়িত্ব কম হওয়ায় বীজতলার তেমন ক্ষতি না হলেও ২ উপজেলার প্রায় ১৬ দশমিক ৫ হেক্টর আমন খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ক্ষতি পোষাতে জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ভাসমান বীজতলা পদ্ধতি শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। প্রাথমিকভাবে ৩ একর কমিউনিটি বীজতলা এবং ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।

কৃষি বিভাগের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন স্থানীয় কৃষকেরা। তাঁরা বলছেন, গ্রামে অনেক পুকুর ও ডোবা থাকে। বন্যা এলে এগুলোতেও পানি ওঠে। কিন্তু বীজতলা যদি ভাসমান করা যায়, তাহলে পানি উঠলেও ক্ষতি হবে না। কিন্তু জমিতে বীজতলা করলে বন্যার পানি উঠলে প্রতিবছরই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

এবারের বন্যায় ডিমলা ও জলঢাকায় ১৫ হেক্টর করে বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরীক্ষামূলক ভাসমান বীজতলার বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক মাজেদুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, সে অনুযায়ী কৃষকদের প্রশিক্ষিত করার জন্য প্রদর্শনী আকারে ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি তিন একর জমিতে কমিউনিটি বীজতলায় আমন চারা তৈরি করা হয়।

বন্যায় আমন আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আপত্কালীন এসব বীজতলার চারা কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনা মূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কৃষকেরা প্রশিক্ষিত হলে আপত্কালীন সময়ে নিজেরাই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারবেন।

কৃষি বিভাগ থেকে জানা গেছে, ভাসমান বীজতলার দৈর্ঘ্য ১০ মিটার এবং প্রস্থ ১ দশমিক ২৫ মিটার। প্রতিটি বেড তৈরিতে কৃষি বিভাগের খরচ হয়েছে ১ হাজার ৩৬৫ টাকা। জেলা সদরের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরুণীবাড়ি অচিনতলা গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলমের (৩০) বাড়ির পাশের পতিত ডোবায় চারটি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। তিনিও এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই বীজতলা তৈরিতে প্রয়োজন হয়েছে একটি কলা গাছের ভেলা। এর ওপর পলিথিন বিছিয়ে পুকুরের পলিমাটি তুলে দেওয়া হয়। পলিমাটির সঙ্গে প্রতিটি বেডে আড়াই কেজি পরিমাণ জৈব সার মিশিয়ে এক কেজি ধানের বীজ ছিটানো হয়েছে। যা একজন শ্রমিক দিয়ে এক দিনেই তৈরি করা সম্ভব। জমিতে বীজতলা তৈরিতে চাষ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশ সময় লাগে। কিন্তু ভাসমান বীজতলায় সময় লাগে কম।

জেলায় এবার ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বীজতলা তৈরি করা হয় ৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে। এসব বীজতলার মধ্যে জেলা সদরে ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর, জলঢাকায় ১ হাজার ৩০৮ হেক্টর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বীজতলার পরিমাণ ৮৬০ হেক্টর।

সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরুণীবাড়ি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম রায় বলেন, ভাসমান বীজতলার প্রদর্শনী দেখে কৃষকদের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কলাগাছ থাকে। কলাগাছ ব্যবহার করে ভেলা তৈরিসহ বীজতলার বেড তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করা একজন কৃষকের জন্য কঠিন কিছু না। এ ছাড়া আমন চারা তুলে এসব বেডে বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করাও সম্ভব। এই পদ্ধতির ব্যাপকতা বাড়লে মাছের ক্ষতি না করে জলাশয় ও পুকুরেও বীজতলা তৈরি সম্ভব।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ১টি পুকুরের ১০ ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হলে মাছ চাষের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং সেটি মাছের শেল্টার হিসেবে কাজ করবে। তবে পুরো পুকুরে ভাসমান বীজতলা করা হলে সূর্যকিরণ বাধাগ্রস্ত হয়ে মাছের ক্ষতি করবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এবার ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বীজতলা তৈরি করা হয় ৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে। এসব বীজতলার মধ্যে জেলা সদরে ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর, সৈয়দপুরে ৪৬০ হেক্টর, ডোমারে ১ হাজার ৭৫ হেক্টর, ডিমলায় ১ হাজার ৬২ হেক্টর, জলঢাকায় ১ হাজার ৩০৮ হেক্টর এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বীজতলার পরিমাণ ৮৬০ হেক্টর।