বন্যায় ১৯৮ কোটি টাকার ক্ষতি, চাষির কপালে চিন্তার ভাঁজ

বন্যায় নওগাঁর নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলার কালীপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। প্রায় আড়াই মাস পানির নিচে থাকা এসব এলাকার ক্ষয়ক্ষতি এখন স্পষ্ট হচ্ছে। দুই দফা বন্যায় এসব এলাকার ফসল ও মৎস্যসম্পদের প্রায় ১৯৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

কৃষকেরা বলছেন, গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি প্রথম দফা বন্যায় নওগাঁ সদর, মান্দা, আত্রাই ও রানীনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের পাটসহ খেতের নানা ফসল তলিয়ে যায়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পানি নেমে গেলে কৃষকেরা ওই খেতে আমন ধানের চারা লাগান। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আরেক দফা বন্যা হয়। এতে ধানও তলিয়ে যায়। দুই দফায় বন্যায় ফসল হারিয়ে কৃষকেরা দিশেহারা।

আত্রাই উপজেলার বাউল্যাপাড়া গ্রামের কৃষক মজির সরদার তিন বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার টাকা। ১৫ শতক জমিতে পটোলের খেতও ছিল তাঁর। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে বন্যায় প্রায় এক মাস ধরে তাঁর পাট ও পটোলের খেত পানির নিচে থাকায় পচে নষ্ট হয়ে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে জমিতে আবার আমন ধানের চারা লাগান তিনি। কিন্তু এক মাস পর দ্বিতীয় দফা বন্যায় তলিয়ে যায় ধানের খেতও। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পানিতে ডুবে থেকে ধানগাছ পচে নষ্ট হয়ে যায়।

মজির সরদার বলেন, ‘দুইবারের বন্যা একেবারে মাজা ভ্যাঙে দিছে। ব্যাঁচে থাকাই এ্যাখন কষ্ট হয়্যা গেছে।’

দুইবারের বন্যা একেবারে মাজা ভ্যাঙে দিছে। ব্যাঁচে থাকাই এ্যাখন কষ্ট হয়্যা গেছে।
মজির সরদার, কৃষক

প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মান্দা উপজেলার চকরামপুর গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেন ধারদেনা করে চার বিঘা জমিতে আমন ধানের চারা লাগান। ধান তুলে ছয় মাসের চাল জোগাড়ের পাশাপাশি পরিবারের অন্য চাহিদা পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু চারা রোপণের এক মাস পরই উজানের ঢলে আত্রাইয়ের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় তাঁর খেতের ফসল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে আত্রাই নদের বাঁধ ভেঙে নওগাঁর নিম্নাঞ্চলের ৫ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। এতে ৭১ কোটি ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন ৩৭ হাজার ৬১১ জন। এর আগে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া বন্যায় ৭ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর্থিক হিসাবে এর পরিমাণ ৭৯ কোটি ১৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এ সময় ৪২ হাজার ৩৮৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হন।

জানতে চাইলে কৃষি অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারিভাবে তাঁদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনা মূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ দিতে কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে মাছ রক্ষা করতে জাল দিয়ে পুকুরের চারপাশ ঘিরে দিয়েছেন এক চাষি। গত বুধবার নওগাঁর আত্রাই উপজেলার বান্দাইখাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্যচাষিরাও

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুই দফা বন্যায় নওগাঁয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবশেষ বন্যায় ৩৫১ হেক্টর জমির ৪৪৭টি পুকুরের ২৩ কোটি ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। প্রথম দফা বন্যায় ৩৭১ হেক্টর জমির ৫৬৩টি খামারের ২৫ কোটি ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, নদ-নদীর পানি কমলেও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বিল মনসুর, গুটার বিল ও দিঘলীর বিলের পানি এখনো কমেনি। এসব এলাকার মৎস্য খামারগুলো তলিয়ে আছে। মৎস্যচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাঁদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে তাঁদের মধ্যে প্রণোদনার টাকা বিতরণ করা হবে।