বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের ১০ বাঁকে বেশি ঝুঁকি

১০ বাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। সওজ ও হাইওয়ে পুলিশের ধারণা, বড় বড় বাঁক থাকা এই ছয় কিলোমিটার অংশের সড়ক খুবই মসৃণ ও প্রশস্ত। ফলে চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এলাকা অতিক্রমের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বরিশাল অংশের বেশির ভাগ বাঁকে নেই সাংকেতিক চিহ্ন। ছবিটি শনিবার উজিরপুর উপজেলার নতুন শিকারপুর এলাকা থেকে তোলা।ছবি: সাইয়ান

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর জয়শ্রী বাজার থেকে বরিশাল বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়ক এলাকা এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই ৬ কিলোমিটার সড়কে রয়েছে অন্তত ১০টি ছোট-বড় বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকে প্রায়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।


গত বুধবার বিকেলে এই অংশের আঁটিপাড়া এলাকায় একটি কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে একটি নবজাতকের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে অ্যাম্বুলেন্সের চালক আলমগীর হোসেন (৪০) ছাড়াও একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে এক সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন। বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বরিশাল অঞ্চলে যেসব ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবই ঘটেছে এই ছয় কিলোমিটার সড়কে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশাল অংশের উজিরপুর উপজেলার জয়শ্রী বাজার মোড় থেকে শুরু করে সাজু ফিলিং স্টেশন মোড়, আঁটিপাড়া মোড়, মুণ্ডপাশা মোড়, নতুন শিকারপুর মোড়, সোনার বাংলা স্কুল মোড়, মেজর এম এ জলিল সেতুর ঢালের মোড়, রাকুদিয়া নতুন হাট মোড়, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন সেতুসংলগ্ন মোড় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। এই ছয় কিলোমিটারজুড়ে একের পর এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় উদ্বিগ্ন সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং হাইওয়ে পুলিশ। তাদের ধারণা, বড় বড় বাঁক থাকা এই ছয় কিলোমিটার অংশের সড়ক খুবই মসৃণ ও প্রশস্ত হওয়ায় যান চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এই এলাকা অতিক্রমের কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।


পুলিশ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি দুই সেতুর মধ্যবর্তী স্থানে একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের গাছে ধাক্কা লেগে দুই যাত্রী মারা যান। ২০১৮ সালের ৩ জুলাই বাস-লরির সংঘর্ষে একজন নিহত ও আহত হন ১৫ জন। ৯ জুলাই জয়শ্রী এলাকায় এক শিশু ও ১৭ নভেম্বর বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক যাত্রী নিহত ও ছয়জন গুরুতর আহত হন। ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইচলাদী এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান একজন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাসের চাপায় সোনার বাংলা স্কুল মোড়ে আবুল হোসেন নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ২ এপ্রিল সাজু ফিলিং স্টেশনের মোড় ঘুরতে গিয়ে মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুই কলেজছাত্র, ১৬ মে ট্রাক ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে এক মোটরসাইকেলের আরোহী ও ১২ আগস্ট পিকআপের ধাক্কায় এক মাছ ব্যবসায়ী নিহত হন। আর গত মাসে বাস থেকে নেমে সড়ক পার হওয়ার সময় ঘটনাস্থলেই নিহত হন এক বৃদ্ধ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এই এলাকার প্রশস্ত ও মসৃণ সড়ক অতিক্রমের সময় যানবাহনগুলোর গতিসীমা সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার লেখা থাকলেও চালকেরা তা মানছেন না। দেখা যায়, এই অংশ অতিক্রমের সময় সব ধরনের যানবাহনের গতিসীমা প্রায় ৮০ কিলোমিটারের ওপরে থাকে। গত বুধবার বিকেলের ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত শুক্রবার বলেন, আঁটিপাড়া এলাকায় যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বড় একটি বাঁক রয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত দুটি যানবাহন বেপরোয়া গতিতে এলাকাটি অতিক্রম করছিল। অ্যাম্বুলেন্সটি একটি বাসকে ওভারটেক করতে গেলে বিপরীত দিক থেকে আসা কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে–মুচড়ে যায়।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, সংযোগ সড়কটি অনেক প্রশস্ত হলেও অনেক বাঁক রয়েছে। এ ছাড়া এই অংশের সড়কের দুপাশে বনায়নের বৃক্ষগুলো বড় হয়ে ঘন বনের মতো হয়ে যাওয়ায় বাঁকগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁকে দিকনির্দেশনাও নেই। ফলে খানাখন্দ না থাকায় এ সড়কে যানবাহনের গতিও থাকে অনেক বেশি।

গাছের ঘন সারির কারণে সড়কের মোড়ে বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন দেখা যায় না। অনেক সময় দ্রুতগতিতে মোড় নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ছবিটি শনিবার উজিরপুর উপজেলার নতুন শিকারপুর এলাকা থেকে তোলা
ছবি: সাইয়ান

উজিরপুরের জয়শ্রী বাজারের ব্যবসায়ী ও বাজার কমিটির সভাপতি জুবায়ের হোসেন বলেন, এই ছয় কিলোমিটার সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধারে তাঁদের অংশ নিতে হচ্ছে। সড়কের দুপাশে ঘন বন থাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো যানবাহনকে দেখা যায় না। এই অংশে বাঁকে দিকনির্দেশক এবং গাছগুলো ছেঁটে দেওয়া উচিত।

বরিশাল সওজ সূত্র জানায়, মূলত এই ছয় কিলোমিটার সড়ক হচ্ছে দুটি সেতুর সংযোগ সড়ক। বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার দোয়ারিকা এলাকায় সুগন্ধা নদীর ওপর বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু অবস্থিত। এরপর দুই কিলোমিটার সামনেই ইচলাদী এলাকায় সন্ধ্যা নদীর ওপরে মেজর এম এ জলিল (শিকারপুর) সেতু অবস্থিত। ২০০৩ সালে সেতু দুটি নির্মাণ হয়। এর আগে এই দুটি নদীতে ফেরি পারাপার ছিল। নির্মিত সেতু দুটিকে ঘিরে বরিশাল বিমানবন্দর মোড় থেকে উজিরপুরের জয়শ্রী বাজার পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়।


গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা ও হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক নিত্যরঞ্জন বলেন, দুটি সেতুর ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক বেশ প্রশস্ত, কোথাও খানাখন্দ নেই। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতির বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ থাকায় চালকেরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। এ কারণেই মূলত বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।