বরিশাল বিভাগে এপ্রিলে ডায়রিয়ায় ৩১ জনের মৃত্যু

বরিশাল সদর হাসপাতাল ডায়রিয়া রোগীতে ঠাসা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হাসপাতালের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিভাগে গেল এপ্রিল মাসে বেসরকারি হিসাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ হাজার ৬৬১ জন। এর মধ্যে এই এক মাসে ডায়রিয়ায় মারা গেছেন ৩১ জন, যার মধ্যে ৩০ জনই মারা গেছেন এপ্রিলের শেষ ১৫ দিনে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নওমারা গ্রামের পিয়ারা বেগম (৩৫) নামের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক নারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা গেছেন। তবে মে মাসে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন এই একজনই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিভাগে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে এপ্রিলে এটা অনেকটাই মহামারি আকার ধারণ করে। চার মাসে বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ হাজার ৫৬৫ জন। এর মধ্যে এপ্রিলেই আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ দশমিক ২৫ শতাংশ রোগী। গত এক সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬৫৮। এ ছাড়া একজন বাদে বাকি সব মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এপ্রিলেই। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত যেসব রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তাঁর কয়েক গুণ বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়েছেন।

চার মাসে বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ হাজার ৫৬৫ জন। এর মধ্যে এপ্রিলেই আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ দশমিক ২৫ শতাংশ রোগী।

আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে, ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৭৩৩ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সরকারি হিসাবে বিভাগে ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৩২। বেসরকারি হিসাবে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে বরগুনার বেতাগীতে রয়েছেন ৬ জন, বরগুনা সদরে মারা গেছেন ১ জন, আমতলীতে ১ , পটুয়াখালী জেলায় ১৮, বরিশালে ৫ ও ভোলায় ১ জন রোগী মারা যান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মারা যাওয়া পটুয়াখালীর ১৮ জনের মধ্যে ৫ জন হাসপাতালে ও ১৩ জন মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বাড়িতে মারা যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত হিসাবে ডায়রিয়ায় ভোলা জেলায় সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছেন। এ জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ১৯২। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী। এ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ১০১ জন। এ ছাড়া বরগুনায় আক্রান্ত ৭ হাজার ৫২০ জন, বরিশালে ৬ হাজার ৪২৫, পিরোজপুরে ৫ হাজার ৯৫৭ ও ঝালকাঠিতে ৫ হাজার ৩৭০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্তর্বিভাগ চালুু না থাকায় রোগীদের ১৬ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক নারীকে রিকশাভ্যানে করে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা। গত শুক্রবার বিকেলে ইন্দুরকানির চাড়াখালী এলাকা থেকে তোলা
প্রথম আলো

ডায়রিয়া পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনুসন্ধানে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বরিশাল ও পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে এবং এর আগে মার্চে বরগুনা জেলায় সমীক্ষা চালায়। বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় সমীক্ষা চালানো দলটির ফলাফল পেতে আরও সময় লাগবে। তবে বরগুনায় প্রতিনিধি দলটি ১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তালিকা ধরে চালানো সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ গভীর নলকূপের পানি পান করলেও দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে খালের পানি ব্যবহার করেন ৭১ শতাংশ মানুষ। সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে। প্রতিষ্ঠানটি বরগুনার খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে তাতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ২০ রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বরগুনার খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে তাতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০ রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এর মধ্যে খাওয়ার ও গৃহস্থালির কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো, খাল-নদীর পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব একটু কমছে। তবে সেটা চোখে পড়ার মতো নয়। আগে যেখানে প্রতিদিন এক হাজারের ওপরে আক্রান্ত হতেন, এখন সেটা হাজারের নিচে নেমেছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যেমন আক্রান্ত রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত আইভি স্যালাইনের মজুত রয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসক, নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’