বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়া রোগী ৫০ হাজার ছাড়াল

বরিশাল সদর হাসপাতাল ডায়রিয়া রোগীতে ঠাসা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হাসপাতালের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়াল। গত ১ জানুয়ারি থেকে আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার ৮২০ জন। এর মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি রোগী আক্রান্ত হয়েছে গত এপ্রিল মাসে। আর মে মাসের ১০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ এপ্রিল থেকে ১০ মে—এই ৪০ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ৬২ শতাংশ রোগী। সঙ্গে ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া রোগীদের সবার মৃত্যু হয়েছে এই ৪০ দিনেই।

সরকারি হিসাবমতে, ডায়রিয়ায় এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে মারা গেছে ১৯ জন। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের হিসাবে এই সংখ্যা ৩৬। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ কেউ বলছেন, দুই যুগেও এত লোকের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ইতিহাস নেই। এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগও অনেকটা চিন্তিত।

আরও পড়ুন

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সোমবার সকাল পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের ছয় জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৪০ জন রোগী। সোমবার পর্যন্ত হিসাবে, বিভাগের মধ্যে ভোলা জেলায় সর্বাধিক রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এ জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজার ২৪৫। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী। এ জেলায় আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ৬২১ জন। এ ছাড়া বরগুনায় আক্রান্ত ৮ হাজার ১৭ জন, বরিশালে ৬ হাজার ৮২০ জন, পিরোজপুরে ৬ হাজার ৪৯৪ জন ও ঝালকাঠিতে ৫ হাজার ৬৩৩ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্তর্বিভাগ চালুু না থাকায় রোগীদের ১৬ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক নারীকে রিকশাভ্যানে করে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা। সম্প্রতি ইন্দুরকানির চাড়াখালী এলাকা থেকে তোলা
প্রথম আলো

বেসরকারি হিসাবে, বিভাগে ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া ৩৬ রোগীর মধ্যে বরগুনার বেতাগীতে আছেন ৬ জন, বরগুনা সদরে ৩ জন, আমতলীতে ১ জন, পটুয়াখালী জেলায় ২০ জন, বরিশালে ৫ জন ও ভোলায় একজন রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মারা যাওয়া পটুয়াখালী জেলার ২০ জনের মধ্যে ৭ জন হাসপাতালে এবং ১৩ জন মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বাড়িতে মারা যান। ৩১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে গত এপ্রিলেই। চলতি মে মাসে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের।

তবে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তার কয়েক গুণ বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়েছেন। ফলে মোট আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

বরগুনার বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শয্যা না পেয়ে বারান্দার মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডায়রিয়া রোগীরা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দুই যুগে ডায়রিয়ার এবারের মতো এমন প্রকোপ আমার অভিজ্ঞতায় নেই। তবে গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমছে। আগে যেখানে প্রতিদিন দেড় হাজারের মতো আক্রান্ত হতো, এখন সেটা অনেক নেমে এসেছে। তবে এটা পুরো নিয়ন্ত্রণে আসতে হয়তো আরও সময় লাগবে। খাওয়ার আগে ও মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গৃহস্থালি কাজে নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা, খোলা স্থানের খাবার না খাওয়া, এসব বিষয়ে তৃণমূলে সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইইডিসিআর পৃথক দুটি প্রশিক্ষণ দিয়েছে।’

ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পৃথক দুটি প্রতিনিধিদল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বরিশাল ও পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে এবং এর আগে মার্চে বরগুনা জেলায় সমীক্ষা চালায়। বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় সমীক্ষা চালানো দলটির ফলাফল পেতে আরও সময় লাগবে। তবে বরগুনায় প্রতিনিধিদলটি ১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তালিকা ধরে চালানো সমীক্ষায় যে ফল পেয়েছে তাতে দেখা গেছে, ৯৪ শতাংশ লোক গভীর নলকূপের পানি পান করলেও দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে খালের পানি ব্যবহার করেন ৭১ শতাংশ মানুষ।

সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে। প্রতিষ্ঠানটি বরগুনার খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে তাতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ২০ রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।