বরিশালের রাজনীতিতে হঠাৎ সক্রিয় বাদ পড়া সরোয়ার

বরিশাল মহানগর বিএনপির বাদ পড়া সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারকে তিন মাস পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায়
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল মহানগর বিএনপির বাদ পড়া সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারকে তিন মাস ধরে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি আকস্মিক বরিশাল জেলা শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বশির আহম্মেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিলে যোগ দেন। পরে তাঁকে সামনে নিয়ে কয়েক শ নেতা-কর্মী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঝটিকা মিছিল করেন।

বরিশাল নগরের পোর্ট রোড জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিলে মজিবর রহমান সরোয়ার বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে যোগ দেন। মূলত এটাকে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান জানান দেওয়ার প্রাথমিক শোডাউন হিসেবে দেখছেন দলের একটি অংশের নেতা-কর্মীরা। অনেকে আবার এটাকে নগর বিএনপির রাজনীতিতে বিভাজনের আলামত হিসেবে দেখছেন।

বরিশাল মহানগর বিএনপির সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি থেকে বাদ পড়া সাবেক নেতারা কয়েক দিন ধরে চা-চক্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ-অবস্থান জানান দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে নানা গুঞ্জন চলছিল। তবে এতে মজিবর রহমান সরোয়ার ছিলেন না। গত ৩ নভেম্বর নগর, উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদনের পর তাঁকে বরিশালে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এমনকি ১ ও ২ মার্চ মহানগর ও জেলা কমিটি আয়োজিত সমাবেশে কেন্দ্রীয় দুই নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রধান অতিথি থাকলেও তিনি ছিলেন না।

এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল শ্রমিক দল। তারা কাকে দাওয়াত দিয়েছে বা দেয়নি, সেটা আমি জানি না। তবে সদ্য ঘোষিত নগর কমিটিতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে দলের পরীক্ষিত নেতাদের কোনো বোঝাপড়া নেই। আমি বলব, এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিএনপি নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার

বঞ্চিত নেতাদের একটি সূত্র বলছে, মজিবর রহমান সরোয়ার গতকাল দোয়া মাহফিলের যে আয়োজনে যোগ দেন, সেখানে ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ আহসান কবির, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি মহসিন মন্টু, আইনজীবী নেতা মো. শহিদ হোসেন, নগর কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আকবর, সহসাধারণ সম্পাদক আনায়ারুল হকসহ অনেকে। পরে সরোয়ারকে নিয়ে তাঁরা মিছিল করেন এবং পদ্মাবতী রোডে জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি খাজা ইকবালকে দেখতে যান।

ওই সূত্র জানায়, গত ১৮ ফ্রেব্রুয়ারি রাতে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন বাদ পড়া নেতারা। নগরের প্যারারা রোডে নগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হকের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ওই বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পর নগর বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস হিসেবে দেখছিলেন দলটির অনেক নেতা।

বরিশাল মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। কমিটিতে মনিরুজ্জামান খান ওরফে ফারুককে আহ্বায়ক, আলী হায়দার ওরফে বাবুলকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। দীর্ঘদিন মহানগর কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। এরপর গত ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা স্থান পাননি।

পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি কেন্দ্রে নাম জমা দেওয়ার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাঁদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি। লিখিত অভিযোগে নেতারা উল্লেখ করেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অর্ধেকের বেশি নেতা ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আর দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের শাসনকালে রাজপথে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁরা অংশ নেননি। তাঁরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং অনেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

মজিবর রহমান ৩০ বছর ধরে নগর বিএনপির সভাপতি পদে ছিলেন। সাংসদ, হুইপ ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁর শক্ত প্রভাব রয়েছে।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মজিবর রহমান সরোয়ারের প্রভাবের কারণে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় অংশটি এবার আহ্বায়ক কমিটি করতে এককাট্টা হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফল হন। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সর্বশেষ বিএনপির মহানগর কমিটি দেওয়া হয়। হঠাৎ বাদ পড়া নেতাদের বৈঠক নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে বরিশাল নগর বিএনপির রাজনীতিতে মেরুকরণের গুঞ্জন চলছিল। শুক্রবার দোয়া মাহফিলে তাঁর যোগদান ও মিছিলের মধ্য দিয়ে তা অনেকটা প্রকাশ্যে এল।

বশির আহম্মেদ আমাদের দলীয় নেতা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে এখানে আমাদের দাওয়াত বা ডাকা হয়নি। তা ছাড়া এর আগের মৃত্যুবার্ষিকীতে এমন অনুষ্ঠান কেন করা হয়নি, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান

বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজিবর রহমান সরোয়ার দলের প্রয়াত এক নেতার দোয়া মাহফিলে যোগ দিয়েছেন। সেখানে দলের অনেক নেতা-কর্মী ছিলেন। পরে আমরা একটি ঝটিকা মিছিল করেছি।’ নতুন আহবায়ক কমিটি নিয়ে সবার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আহ্বায়ক, দুজন যুগ্ম আহ্বায়ক নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু অন্যদের নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাঁদের ঘুম থেকে তুলে ঘর থেকে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এটি দলের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’

নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান অবশ্য বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে চান না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বশির আহম্মেদ আমাদের দলীয় নেতা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে এখানে আমাদের দাওয়াত বা ডাকা হয়নি। তা ছাড়া এর আগের মৃত্যুবার্ষিকীতে এমন অনুষ্ঠান কেন করা হয়নি, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’ এটা দলের মধ্যে বিভাজনের ইঙ্গিত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে এভাবে বলতে বা দেখতে চাই না। তিনি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা। এখানে দোয়া অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। সেটি আমাদের সবাইকে নিয়ে করলে আরও সুন্দর হতো।’

এ প্রসঙ্গে মজিবর রহমান সরোয়ার আজ শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল শ্রমিক দল। তারা কাকে দাওয়াত দিয়েছে বা দেয়নি, সেটা আমি জানি না। তবে সদ্য ঘোষিত নগর কমিটিতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে দলের পরীক্ষিত নেতাদের কোনো বোঝাপড়া নেই। আমি বলব, এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি যাঁদের দিয়ে এই কমিটি দিল; তাঁদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া, যাঁরা বরিশালে দীর্ঘদিন শ্রম দিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া, এটা একটি বাজে নজির স্থাপন হয়েছে। এটা কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়হীনতার কারণে হয়েছে।’ এতে দলে বিভাজন স্পষ্ট হলো কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো এখানে আর ফিরব না। তবে যাঁরা দলকে এত বছর বয়ে এনেছেন, তাঁদের বাইরে রেখে দিলে তো ক্ষোভ থেকেই যাবে।’