বরেন্দ্রর জলে সমুদ্রের শৈবাল

তানোর উপজেলার আমশো গ্রামে ১৭ হাজার লিটার পানির কৃত্রিম জলাধার তৈরি করেছেন রাকিবুল।

সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনা চাষের জন্য নির্মাণ করা কৃত্রিম জলাধার। সেখান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে শৈবাল। গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর তানোর উপজেলার আমশো গ্রামে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

সমুদ্রের ক্ষারীয় পানিতে সুতার মতো ভেসে থাকে ক্ষুদ্র শৈবাল ‘স্পিরুলিনা। নীলাভ সবুজ এই শৈবাল সূর্যালোকের মাধ্যমে দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ থাকায় খাদ্য উপাদান হিসেবে তো বটেই, নানা রোগ নিরাময়েও দেশে–বিদেশে বেশ চাহিদা স্পিরুলিনার। বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর তানোরে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে সামুদ্রিক এই শৈবালের।

তানোরের কলেজশিক্ষক রাকিবুল সরকার ওরফে পাপুল বাণিজ্যিকভাবে এ শৈবাল চাষ শুরু করেছেন। তাঁকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন তানোরের স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত নূর মোহাম্মদ। গত বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) প্রথম এ শৈবাল আহরণ করা হয়েছে। এই শিক্ষকের দাবি, দেশে সবচেয়ে বড় আকারে তিনিই এ শৈবাল চাষ করছেন।

স্পিরুলিনা চাষের জন্য তানোর উপজেলার আমশো গ্রামে ১৭ হাজার লিটার পানির কৃত্রিম জলাধার তৈরি করেছেন রাকিবুল। এ জলাধার ঘিরে সূর্যের আলো প্রবেশ করার মতো স্বচ্ছ প্লাস্টিক টিনের একটি ঘর তৈরি করেছেন। গত ৪ জানুয়ারি তিনি বীজ হিসেবে শৈবালসহ ১৫ লিটার পানি তাঁর জলাধারে দিয়েছেন। এরপর কৃত্রিম উপায়ে ১৭ হাজার লিটার পানিতে এ শৈবাল বেড়ে উঠছে।

রাকিবুল জানান, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার দেলোয়ার হোসেন এ শৈবাল চাষের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা। সারা দেশে তিনি এ ব্যাপারে উৎসাহী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে রাকিবুল সরকার ও কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নূর মোহাম্মদের নেশা নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করা। তাঁর ছয়টি জাত বর্তমানে জাতীয় বীজ বোর্ডে স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে। নূর মোহাম্মদ কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন।

রাকিবুল সরকার বলেন, কৃত্রিম জলাধারে সমুদ্রের পানির উপাদান তৈরির জন্য ওষুধ দিতে হয়। এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার টাকার সমুদ্রের পানির উপাদান এতে দিতে হয়েছে। এতে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত চলবে। তারপর পানি যতটুকু কমে যাবে, ততটুকু বাড়ানোর জন্য আবার পানির অনুপাতে সেই উপাদান দিতে হবে। সব মিলে তাঁর সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিনি আশা করছেন, আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁর বিনিয়োগ উঠে আসবে। এক সপ্তাহ পরপর আহরণ করা যাবে। প্রতি মাসে শুকনা স্পিরুলিনা ৩০ থেকে ৪০ কেজি হতে পারে। শীতের সময় রোদ কম থাকায় উৎপাদনের পরিমাণ একটু কম হয়।

বৃহস্পতিবার সকালে রাকিবুল সরকারের খামারে গিয়ে দেখা যায়, একটি পাইপের মাধ্যমে জলাধারের শৈবালমিশ্রিত পানি একটি ছাঁকনিতে এসে পড়ছে। তাতেই শৈবাল ধরা পড়ছে। বিকেলে যোগাযোগ করা হলে রাকিবুল সরকার বলেন, ছয় থেকে সাত কেজি কাঁচা শৈবাল পেয়েছেন। এ থেকে তিন ভাগের এক ভাগ শুকনা শৈবাল পাওয়া যাবে। প্রথমবার তাঁর ২০ কেজি কাঁচা শৈবাল উঠবে বলে তিনি আশা করছেন। এরপর প্রতি সপ্তাহে আহরণ করা যাবে।

মুঠোফোনে ঝিনাইদহের দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শের-ই-বাংলা কৃষি বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জালাল উদ্দিনের কাছ থেকে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। গত বছর থেকে দেশে বেসরকারিভাবে তিনিই কৃত্রিম জলাধারে এর চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত দেশে প্রায় দেড় শ জলাধার হয়েছে। তার মধ্যে তানোরেরটাই সবচেয়ে বড়। তিনি বলেন, তাঁর ‘দেলোয়ার অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাঁরা চাষির কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে এই শৈবাল কেনেন। প্রক্রিয়াজাত করে তাঁরা ছয় হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, যাঁরা রঙিন মাছ চাষ করেন, তাঁরা থাইল্যান্ড থেকে এগুলো উচ্চ মূল্যে কিনে আনেন। দেশের উৎপাদিত শৈবাল তাঁরা এখানে সুলভ মূল্যে পাচ্ছেন। শের-ই-বাংলা কৃষি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এর মধ্যে ক্ষতিকারক কিছু নেই। এ শৈবাল ডিম, দুধ, মাংস, মাছ ও শাকসবজির চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিমানসম্পন্ন।