বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়ায় বিষাক্ত করোনা ইউনিটের পরিবেশ

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সামনে বর্জ্যের ভাগাড়। গতকাল সকালে।ছবি: সাইয়ান

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সামনের ভাগাড় উপচে পড়ছে বর্জ্য। অপসারণ না করে এসব বর্জ্য প্রায়ই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠে করোনা ইউনিটের পরিবেশ।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর হাসপাতালটিতে বর্জ্য অপসারণ দেড় বছর বন্ধ ছিল। সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মূল হাসপাতাল ভবনের পেছনের ভাগাড়ের বর্জ্য অপসারণ শুরু করেছেন। কিন্তু করোনা ইউনিটের সামনের ভাগাড় থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে না।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে হাসপাতালের মূল ভবনের পেছনে খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলা হতো। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেই বর্জ্য অপসারণ করতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর গত বছরের এপ্রিল থেকে বর্জ্য অপসারণ না করায় ওই ভাগাড় ভরাট হয়ে যায়। ফলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মূল ফটকের পাশে এবং করোনা ইউনিটের সামনে গত বছরের জুলাইয়ে দুটি বড় গর্ত করে সেখানে বর্জ্য ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে জরুরি বিভাগের পাশের গর্তটি ভরাট হয়ে ময়লা-আবর্জনা উপচে পড়ায় সেটি গত বছরের শেষ দিকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এখন করোনা ইউনিটের সামনের ভাগাড়টিতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সেটিও উপচে পড়ছে। ভাগাড়টি থেকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বর্জ্য অপসারণ না করায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আগুন দিয়ে সেগুলো প্রায়ই পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী, থ্রি-আর পদ্ধতিতে এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাধ্যবাধকতা আছে। থ্রি-আর মানে হচ্ছে রিডিউজ, রিসাইকেল ও রিইউজ। অর্থাৎ কমসংখ্যক বর্জ্য উৎপাদন, বর্জ্যকে নবায়নযোগ্য করা ও পুনর্ব্যবহার করা। মেডিকেল বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে একে তিন ভাগে ভাগ করে তা পরিবহন করতে হবে। অবশ্যই পরিবহনকারী কর্মীদের পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক পরতে হবে।

উচ্ছিষ্ট খাবার, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্যালাইনের ব্যাগ, বিভিন্ন ওষুধের খোসা, গ্লাভস, পানির বোতল, প্লাস্টিকের বাটি, মাস্ক, টিস্যু, পলিথিন, ওয়ান টাইম প্যাকেটসহ বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল বর্জ্য যখন পোড়ানো হয়, তখন ধোঁয়ায় করোনা ওয়ার্ডে আসা রোগী ও স্বজনদের দম আটকে আসার অবস্থা হয়। একই সঙ্গে দুর্গন্ধে প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে পরিবেশ।

গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের পূর্ব দিকে করোনা ইউনিটের সামনেই রাস্তা ঘেঁষে বিশাল আয়তনের পুকুরের মতো খোঁড়া গর্তটি বর্জ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। কয়েকজন টোকাই এসব বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক ও অপচনশীল জিনিসপত্র বাছাই করে বস্তায় ভরছে।

করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর স্বজন নিজাম উদ্দীন বলেন, হাসপাতালের সামনে এভাবে বর্জ্যের ভাগাড় থাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায়। আবার যখন আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয়, তখন পলিথিন, প্লাস্টিক পোড়া গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

করোনা ইউনিটের প্রধান হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান শাহীন বলেন, ‘বর্জ্য অপসারণ করা না হলে এগুলো রাখার তো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। এখন অসুবিধা হলে আমরাও তো নিরুপায়।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এক হাজার শয্যার এ হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ে দুই হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া প্রতিদিন বহির্বিভাগে তিন–চার হাজার রোগী আসেন। এই রোগীদের চিকিৎসা বর্জ্য হিসেবে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই মেট্রিক টন বর্জ্য জমা হয় হাসপাতালে। এর বাইরে পাঁচ তলাবিশিষ্ট করোনা ইউনিটটি হাসপাতালের অন্যান্য ভবন থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সেখানে ৩০০–এর বেশি রোগী থাকছেন, থাকছেন তাঁদের স্বজনেরাও। এ ছাড়া প্রতিদিন এই হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে আসছেন শতাধিক লোক। ফলে এখন বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে প্রতিদিন তিন-চার মেট্রিক টন হয়েছে।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের প্রধান রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস দেড়েক আগে মূল ভাগাড়ের বর্জ্য আমাদের কর্মীরা অপসারণ শুরু করেছেন। কিন্তু করোনা ইউনিটের সামনের ভাগাড়টির বর্জ্য অপসারণ না করে মাটিচাপা দেওয়া হবে। প্রতিদিন সেখানে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণু ধ্বংস করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

তবে ক্লিনিক্যাল বর্জ্যে ব্লিচিং পাউডার ছিটালে কিংবা এগুলো মাটিচাপা দিলেও এর তেজস্ক্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এগুলো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। বরং মাটিতে মিশে একধরনের টক্সিন তৈরি করে, যা পানি, মাটি, প্রকৃতি ও মানবদেহের ওপর খুবই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। হাসপাতালের মধ্যে এমন ভাগাড় অবশ্যই গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।