বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম খতিয়ে দেখার ঘোষণা সুনামগঞ্জের ডিসির

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ধারাইন নদের তীর উপচে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে গোবরির হাওরের বোরো ধান। আজ বুধবার সকাল ১০টার দিকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলহানি ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করার ঘোষণা দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতিও। গতকাল মঙ্গলবার রাতে জেলার ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওরে ভেঙে যাওয়া বাঁধ পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

এদিকে সুনামগঞ্জে নদ, নদী ও হাওরে পানি স্থিতিশীল আছে। আজ বুধবার সকাল নয়টায় সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার, যেটি বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার নিচে। গতকাল একই সময়ে সেটা ছিল বিপৎসীমা বরাবর, অর্থাৎ ৬ মিটার। নদীতে পানি কিছুটা কমেছে।

তবে শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান চোখের সামনে তলিয়ে যাবে, এটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না হাওরের কৃষকেরা। তাই উদ্বিগ্ন কৃষকদের দিনরাত কাটছে হাওরে, ফসল রক্ষা বাঁধে। গতকাল রাতেও জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরে বাঁধ মেরামতের কাজ করেছেন তাঁরা। জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপারের মুক্তিখলা গ্রামের কৃষক আবদুল গনী আনসারী (৬০) বলেন, ‘কখন বাঁধ ভাঙে, এ চিন্তা পেয়ে বসেছে। তাই যত সময় পারি বাঁধেই কাটাই। গত দুই রাত বাঁধে ছিলাম। সাহ্‌রি খেয়ে কিছু সময় ঘুমিয়ে সকালে আবার হাওরে চলে এসেছি।’

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গতকাল বলেন, ‘আমি একটি তদন্ত কমিটি করব। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, যাঁদের কর্তব্যে অবহেলা হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি তিনি সরকারি কর্মকর্তা হন, তাহলে আমরা সরকারের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করব। যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করব। জনপ্রতিনিধি হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে সুপারিশ করব।’

গত এক সপ্তাহের উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে জেলার সব কটি হাওরে ফসল ঝুঁকিতে পড়েছে। গত শনিবার তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি বাঁধ ভেঙে প্রথমে ফসল তলিয়ে যায়। এরপর জেলার শাল্লা উপজেলায় তিনটি, সদর উপজেলায় একটি, ধর্মপাশা উপজেলায় একটি হাওরে ফসলহানি ঘটেছে।

জেলার বিভিন্ন হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধে দিনরাত স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন লোকজন। তবুও হাওরের ফসল রক্ষা করা যাচ্ছে না। গতকাল রাতেও বিভিন্ন হাওরে উদ্বিগ্ন লোকেরা কাজ করেছেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরাও আছেন। যে হাওরগুলোতে এখনো ঢলের পানি ঢোকেনি কিংবা বাঁধগুলো ভাঙেনি, সেগুলো রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন সবাই। অনেক বাঁধে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানেই সমস্যা হচ্ছে, সেখানেই হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে অবস্থান নিয়ে সেগুলোর নজরদারি ও রক্ষায় কাজ করতে গ্রামে গ্রামে মসজিদে মাইকিং করা হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন। এবারও নির্ধারিত সময়ে বাঁধে কাজ শেষ না হওয়া, প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব হওয়া এবং কাজে অনিয়মকেই ফসলহানির জন্য দায়ী করছেন তাঁরা।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা বলছেন, ভারতের চেরাপুঞ্জির অতিবৃষ্টিই ভয়ের মূল কারণ। সুনামগঞ্জে স্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু চেরাপুঞ্জিতে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ায় ঢল নামছে। এতেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে প্রশাসন, পাউবো কর্মকর্তাসহ সবাই মাঠে আছেন। যেখানে যা যা প্রয়োজন, ফসল রক্ষার স্বার্থে সব করা হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৭২৭টি প্রকল্পে ৫২০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ হয়েছে। এতে বরাদ্দ আছে ১২১ কোটি টাকা।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা সবাইকে নিয়ে হাওরের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু উজান থেকে অস্বাভাবিক পরিমাণে ঢল নেমে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উজানে বৃষ্টি কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের কাজ হতো। ২০১৭ সালের ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করা হয়। বাদ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রথা। কাজে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা প্রশাসনকে।

হাওরে বাঁধ নির্মাণের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, নভেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনের কথা। এর আগে উপজেলা থেকে প্রকল্প ও পিআইসিগুলো অনুমোদন হয়ে জেলা কমিটিতে আসবে। পরে জেলা কমিটি সেগুলো অনুমোদন দেয়। স্থানীয়ভাবে কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য একটি করে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের পিআইসি গঠন করা হয়। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। বাঁধের মূল কাজ শুরু হওয়ার কথা ১৫ ডিসেম্বর। কাজের শেষ সময় ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বছরই নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ করা যায়নি।