বাঁধ মেরামত না হলে বাসুদেবদের ঘরে ফেরা হবে না

জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। পানি ঢুকেছে বাড়িঘরে। নিরুপায় হয়ে একটি পরিবার বাঁধে ঠাঁই নিয়েছে। খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি এলাকায়ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাতিরঘেরি এলাকার বাসুদেব দাশের গৃহস্থ পরিবার ছিল। মাছের ঘের ও অন্যান্য কাজ করে পরিবার নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু গত বুধবার জোয়ারের পানির চাপে তাঁর বাড়ির পাশেই থাকা শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। মুহূর্তেই পানিতে তলিয়ে যায় সবকিছু। কিছু জিনিসপত্র রক্ষা করতে পারলেও অনেক কিছু ভেসে গেছে ওই পানির তোড়ে। বৃহস্পতিবার ভাটায় পানি নেমে যাওয়ার পর একটি নৌকায় করে ঘরের জিনিসপত্র ও মালামাল নিয়ে হরিহরপুর লঞ্চঘাট এলাকায় বাঁধের ওপর বসতি স্থাপন করেছেন।

বাসুদেবের মতো আরও কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন ওই বাঁধের ওপর। বাসুদেব বলেন, ‘আইলার সময়ও এত জোয়ারের পানি হয়নি। ঝড়ের সময় প্রস্তুতি নিলেও ঘর ছাড়তে হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। এখন কোনোরকম মাথা গুঁজে আছি। বাঁধ মেরামত না হলে আর ঘরে ফেরা যাবে না। গরু-ছাগল আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছি।’

বাসুদেব দাশের মতোই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন খুলনার কয়রা উপজেলার অন্তত ২৬টি গ্রামের মানুষ। ঘরে খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, খাওয়ার পানিরও সংকট। সব মিলিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ ছুটছেন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু সেখানেও ঠাঁই নেই। মানুষ পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পুকুপাড়, সড়কসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে।

সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে উপজেলার মহারাজপুর ও বাগালী ইউনিয়নের মানুষ। ওই দুই ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের মধ্যে নিয়মিত জোয়ার–ভাটা আসা-যাওয়া করছে। আধা পাকা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। গবাদিপশু ও অন্যান্য আসবাব আশপাশের বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়িতে রাখছে মানুষ। খাবার পানির উৎস পুকুর ও নলকূপগুলো নোনাপানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানির প্রচণ্ড সংকটে পড়েছে মানুষ। উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তাঁরা।

এদিকে নোনাপানির প্রভাবে পুকুরের মাছসহ অন্যান্য জীব মরে গিয়ে এলাকায় ব্যাপক দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাদুর্ভাব ঘটেছে পেটের পীড়া, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগের।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট উচ্চ জোয়ারে খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়। তবে বর্তমানে জোয়ারের পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় কয়রা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় আর জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে না। কিন্তু কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানের বাঁধ এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে ওই ভাঙা স্থানগুলো দিয়ে ওই দুই ইউনিয়নসহ আশপাশের ইউনিয়নের গ্রামগুলোও প্লাবিত করছে।

আশ্রয়ের খোঁজে কয়রার মানুষ ছুটছেন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে, পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন পুকুপাড়, সড়কসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে
ছবি: প্রথম আলো

এর মধ্যে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাতিরঘেরি এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙনে প্লাবিত হচ্ছে ওই ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, হরিহরপুর, পদ্মপুকুর ও চরামুখা গ্রাম। ওই ভাঙনের পানি প্লাবিত করছে পাশের দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বীণাপানি ও হলুদবুনিয়া গ্রামের কিছু অংশ।

ইয়াসের প্রভাবে উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহারাজপুর ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের পশ্চিম পাশে দশহালিয়া এলাকার কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে প্লাবিত হচ্ছে লোকা, কালনা, মেঘারাইট, সিমনার আইট, খেজুরডাঙ্গা, আটরা, গোবিন্দপুর, দশহালিয়া, জয়পুর ও দেয়াড়া গ্রাম। এ ছাড়া প্লবিত হচ্ছে কয়রা সদর ইউনিয়নের উত্তর মদিনাবাদের আংশিক ও বাগালী ইউনিয়নের বাইলহারানিয়া, শ্রিফলতলা, কলাপাতা, বাগালী, ঘুগরোকাটি, দক্ষিণ ঘুগরোকাটি, বামিয়া, ইসলামপুর, হোগলা ও শেওড়া গ্রাম।
ওই ইউনিয়নের পূর্ব দিকে মঠবাড়ি ও পবনা এলাকায় শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙনে প্লাবিত হয়েছিল আরও অন্তত পাঁচটি গ্রাম। কিন্তু ওই দুই জায়গার বাঁধ মেরামত করে দেওয়ায় এখন গ্রামগুলো আর প্লাবিত হচ্ছে না।

বাগালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাত্তার পাড় বলেন, এমন দুর্ভোগ আইলার সময়ও কেউ পড়েনি। পুরো ইউনিয়নের অন্তত চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগ পানিতে তলিয়ে আছে। ওই ইউনিয়নের কোনো স্থান থেকে বাঁধের ভাঙন হয়নি বলে জানান তিনি।

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার জায়গা না পেয়ে খেজুরবুনিয়া পুকুরপাড়ের চারপাশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৩০টি পরিবার। অধিকাংশই পলিথিন দিয়ে খুপড়ি তৈরি করে কোনোরকমভাবে সেখানে রয়েছেন। তাঁদেরই একজন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, প্রথম দিনই ঘরের মধ্যে কোমরসমান পানি ওঠে। ভাটার সময়ও থাকে হাঁটুপানি। পরদিন ঘর ভেঙে পড়ে। এরপর আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি, তাই পুকুরপাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া ওই মানুষগুলো জানান, সরকারিভাবে তাঁরা এখনো কোনো খাদ্যসহায়তা পাননি।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেশ বিশ্বাস বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের আড়াই টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শুকনা খাবার কিনে বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার করে টাকা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা বাঁধ মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকায় খাদ্যসহায়তা করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। একটি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে খাওয়ার পানি সরবরাহ করছে।