বাংলাবাজার ফেরিঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় হাজারো মানুষ

দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ঢাকামুখী মানুষেরা ফেরিতে ওঠার জন্য গাদাগাদি করে এগোচ্ছে। শনিবার বেলা ৩টার দিকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাট এলাকায়ছবি: অজয় কুন্ডু

আজ শনিবার বেলা তিনটা। ঢাকামুখী যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে। পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছেন কয়েক হাজার যাত্রী। ফেরি চলাচল সীমিত হওয়ায় ঘাটের পন্টুন ও আশপাশে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। এতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। ঢাকামুখী যাত্রীরা বলছেন, রোববার থেকে পোশাকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলবে। তাই চাকরি বাঁচাতে বাধ্য হয়েই বিধিনিষেধের মধ্যেই তাঁদের ঢাকায় ফিরতে হচ্ছে।

বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সালাউদ্দিন আহমেদ বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাটে প্রচুর ভিড়। এত ভিড়ে কোনো কিছুই ঠিকমতো করা সম্ভব না। আমাদের ১০টি ফেরি চলছে। এর বেশি ফেরি চালাতে আমরা পারছি না। আমাদের ডাম্প ফেরিসহ বেশ কয়েকটি ফেরি অলস পড়ে আছে। অলস পড়ে থাকা ফেরিগুলো স্রোতের কারণে আপাতত চলতে পারছে না।’

সরেজমিন বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বাংলাবাজার ফেরিঘাট ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার ঢাকামুখী যাত্রীরা ভ্যান, রিকশা, ইজিবাইক, সিএনজি, মাহিন্দ্র, ট্রাক ও ট্রলিতে করে ঘাট এলাকায় প্রবেশ করেছেন। অনেকে গাদাগাদি করে এসব গাড়িতে না উঠে হেঁটেই আসছেন ঘাটে। ঘাট এলাকায় ঢুকতে পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও পোশাকশ্রমিক পরিচয় বলায় তাঁদের কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঘাটে এসে যাত্রীরা ফেরি পাচ্ছেন না। ফেরির জন্য তাঁদের পন্টুন ও ঘাটের আশপাশেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ঘাটে ফেরি আসামাত্রই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ওঠার জন্য। যাত্রীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ থাকায় ফেরিগুলো যানবাহন নামানো-ওঠানোতেও নানা সমস্যায় পড়ছে।

মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় ভর্তি ফেরি। শনিবার দুপুরে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে
ছবি: অজয় কুন্ডু

ঢাকা হয়ে গাজীপুর যাবেন বরগুনা থেকে আসা যাত্রী জুয়েল হোসেন (৪০)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভোর চারটায় রওনা করছি। ঘাটে পৌঁছালাম বেলা দুইটায়। সারা রাস্তায় কোথাও মাইলের পর মাইল হেঁটে, আবার ট্রাকে উঠে, ভ্যানে উঠে অনেক কষ্টে ঘাট পর্যন্ত আইছি। কখন ঢাকায় যাব আর কখন গাজীপুরে যাব? সকাল থেকে পানি ছাড়া কিছুই খেতেও পারি নাই। খুব কষ্ট হইতাছে। জীবন তো আর চলছে না আমাগো। এত কষ্ট করে কি আর যাওয়া যায়!’

বরিশাল থেকে চার বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন পোশাকশ্রমিক নাজমা আক্তার (৩৫)। চাকরি বাঁচাতে হলে তাঁকেও অন্যদের মতো আজই ঢাকায় ফিরতে হবে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরিডা না থাকলে কেউ দেখবার থাকবে না। বাঁচতে হলে মইরা-বাঁইচা য্যামনে হোক ঢাকায় ফিরতে হবে। নইলে কামডা হারাইতে হবে।’

যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় থাকায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো ফেরিতে উঠতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ভোগের শিকার হয়। শনিবার বিকেলে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে
ছবি: অজয় কুন্ডু

১০ কিলোমিটার বেশি হেঁটে ঘাটে আসছেন আবুল কালাম (৫৫)। বরিশাল থেকে আসা এই যাত্রী বলেন, ‘বরিশাল থেকে প্রথম ১০ কিলোমিটার বেশি হাঁইটা ট্রাকে উঠছি। তিন গুণ ভাড়া দিয়া ঘাটে আইলাম। ফেরি ঘাটে নাই। মানুষ আর মানুষ অপেক্ষায় আছে। এত মানুষের মধ্যে কীভাবে ফেরিতে উঠব, সেই চিন্তায় আছি।’

ট্রাক, পিকআপ তো রয়েছেই, ঝুঁকি নিয়ে ট্রলি–ট্রাক্টরও যাত্রী নিয়ে ছুঁটে চলছে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে। শনিবার দুপুর ২টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভূরঘাটা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়
ছবি: অজয় কুন্ডু

বিকেল চারটার দিকে বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) জামালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাজার পেরিয়ে লাখ লাখ মানুষ পার হওয়ার জন্য এখন ঘাটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফেরিতে এত মানুষের ঠেলায় একটি গাড়িও লোড দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিমুলিয়া থেকে খালি ফেরি আসছে আর বাংলাবাজার থেকে পুরো ভর্তি হয়ে যাত্রীরা শিমুলিয়া যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় থাকায় ঘাটে ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স তিন ঘণ্টা ধরে আটকা পড়ে আছে। ফেরিতে তুলতে পারছি না। এটা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তায় আছি। রোগীদের পার করতে আমরা পারছি না। ফেরিঘাটে আসামাত্রই মানুষে ভরে যাচ্ছে। গিজগিজ করছে মানুষে। এত মানুষের চাপ থাকায় ঘাটে প্রায় ৩০০ ছোট গাড়ি, পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। এগুলো কী করে পার হবে, তা কিছুই বলতে পারছি না।’