বাংলার বায়রন

দুই দফায় প্রায় আট বছর ফেনীতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন ফেনী একটি জলা-জঙ্গলবেষ্টিত জনপদ। তিনি উদ্যোগী হয়ে একে একটি সুন্দর বাসযোগ্য নগরীতে উন্নীত করেছিলেন।

নবীন চন্দ্র সেন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যবর্তী সময়ের কবিদের মধ্যে হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছেন। দুজনই মহাকাব্য লিখেছেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাকাব্যের নাম বৃত্রসংহার আর নবীনচন্দ্র সেনের মহাকাব্য দুটি—পলাশীর যুদ্ধ এবং তিন খণ্ডে রচিত মহাকাব্য রৈবতক, কুরুক্ষেত্রপ্রভাস। দুজনই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন, উভয়েই গীতিকবিতাও লিখেছেন। সমালোচকদের বিচারে কাব্যপ্রতিভায় হয়তো হেমচন্দ্র একটু এগিয়ে থাকবেন। তবে নবীনচন্দ্রের কর্মজীবন ব্যাপ্ত ও বহু কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া পলাশীর যুদ্ধই প্রথম বড় কাব্য, যা পৌরাণিক বিষয়ের বাইরে অনতিকালপূর্বের ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে রচিত, যে ইতিহাসের সঙ্গে বাংলা এবং ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাস গভীরভাবে যুক্ত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় পলাশীর যুদ্ধ কাব্যের একটি আলোচনা লিখেছিলেন। তাতে একে তিনি ঐতিহাসিক এবং অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বঙ্কিম সচেতন। তিনি লিখেছেন, এতে ‘উপাখ্যান এবং নাটকের ভাগ অতি অল্প। গীতি অতি প্রবল।’ আবার প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘নবীনবাবু বর্ণনা এবং গীতিতে একপ্রকার মননসিদ্ধ, সেই জন্য পলাশীর যুদ্ধ মনোহর হইয়াছে।’ সেকালে শিক্ষিত বাঙালিমানসে যখন দেশ, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার বিকাশ ঘটছিল, তখন নবীনচন্দ্রের এই কাব্য পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাই বইটি পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। তবে নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ কাব্যে সিরাজউদ্দৌলা মুখ্য ব্যক্তি নন। তখন তিনি সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে ইংরেজের চাকরি করছেন অথবা হয়তো ইংরেজদের রচিত ইতিহাসে বর্ণিত সিরাজের চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে দেশপ্রেমের ভক্তি ও শক্তির ভাষ্যগুলো এসেছে প্রধানত মোহনলালের বক্তব্যে এবং রানি ভবানীর বাচনে। পরবর্তীকালে দেখা যায়, গিরিশ ঘোষের সিরাজউদৌল্লা এবং আরও পরে শচীন্দ্রনাথ সেনের একই নামের নাটক প্রচারিত হলে সিরাজ ও পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে বাঙালিমনের ভাবাবেগ ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। সিরাজ তখন স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর, দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠেন। নবীন সেনের মহাকাব্য সম্ভবত আখ্যান অংশের দুর্বলতা আর গীতলতার প্রাবল্যের কারণে এবং জাতীয় কণ্ঠস্বরের অভাবে ক্রমেই পাঠকদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।

অন্যদিকে এই কাব্যকে বঙ্কিম ‘তেজস্বিনী, জ্বালাময়ী এবং অগ্নিতুল্য’ আখ্যা দিয়ে ইংরেজ রোমান্টিক কবি লর্ড বায়রনের চাইল্ড হ্যারান্ড কাব্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রসঙ্গত আরও লিখেছেন, ‘বায়রনের ন্যায় নবীনবাবু বর্ণনায় অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, বায়রনের ন্যায় তাঁহারও শক্তি আছে, দুই–চারটি কথায়, তিনি উত্কৃষ্ট বর্ণনার অবতারণ করিতে পারেন।’ শেষ পর্যন্ত তিনি নবীনচন্দ্র সেনকে ‘বাংলার বায়রন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনও বলেছেন, ‘পলাশীর যুদ্ধ যে বাঙ্গালা সাহিত্যভাণ্ডারে একটি বহুমূল্য রত্ন, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই।’ তাঁর তিন খণ্ডের মহাকাব্য রৈবকত, কুরুক্ষেত্রপ্রভাস–এ তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই মুখ্য চরিত্র করে আর্য-অনার্য দুই সম্প্রদায়কে মিলিত করে প্রেমরাজ্য স্থাপনে কৃষ্ণের অভিনব এক প্রয়াসের বর্ণনা দিয়েছেন। আজকের অপ্রেম ও অসহিষ্ণুতার কালে কুরুক্ষেত্র তো যত্রতত্র সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাই সম্প্রীতির এই বারতা হয়তো নতুনভাবে কালোপযোগী রচনার দিশা দিতে পারে নতুন কালের কবিকে। নবীনচন্দ্র পরবর্তীকালে যিশুখ্রিষ্ট, বুদ্ধদেব ও শ্রীচৈতন্যের জীবন অবলম্বনে তিনটি কাব্য লিখেছিলেন—খ্রিষ্ট, অমিতাভ এবং অমৃতাভ। তাঁর প্রথম বই অবশ্য প্রেমের গীতিকবিতার সংকলন—অবকাশ রঞ্জিনী, প্রকাশকাল ১৮৭১ সাল।

২.

নবীনচন্দ্র সেনের জন্ম চট্টগ্রামে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু চট্টগ্রামে ১৯০৯ সালে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে (সেকালে নাম ছিল চট্টগ্রাম হাইস্কুল) প্রবেশিকা পাস করেন ১৮৬৩ সালে। এরপর কলকাতায় যান উচ্চশিক্ষার জন্য। ১৮৬৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এফএ এবং ১৮৬৯ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ (সেকালে নাম ছিল জেনারেল অ্যাসেমব্লিস ইনস্টিটিউশন) থেকে বিএ পাস করেন। কিছুদিন কলকাতার বিখ্যাত হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নবীনচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। এ পদে তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এ সময়কার জীবনের দুটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। যখন তিনি চট্টগ্রামে চাকরিরত ছিলেন, তখন পুঁথি সংগ্রাহক ও গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে তাঁর অধীনে কেরানির চাকরি দিয়েছিলেন। পুঁথি সংগ্রহের অত্যুৎসাহে আবদুল করিম প্রাচীন পুঁথি আহ্বান করে তত্কালীন স্থানীয় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি ছেপেছিলেন, যা সরকারি চাকুরের বিধিতে নিষিদ্ধ। এর ফলে কবি একটু বিপদেই পড়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ রচনার জন্যও নবীন সেন ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়েছিলেন। তবে দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রশাসক হিসেবে তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। তিনি দুই দফায় প্রায় আট বছর ফেনীতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন ফেনী একটি জলা-জঙ্গলবেষ্টিত জনপদ। তিনি উদ্যোগী হয়ে একে একটি সুন্দর বাসযোগ্য নগরীতে উন্নীত করেছিলেন। এ ছাড়া ফেনী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি, যা এখন ফেনী সরকারি পাইলট হাইস্কুল নামে পরিচিত।

নবীনচন্দ্র প্রথম জীবনে তৎকালীন মাদারীপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। তখন তাঁর কবিখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর এবং তিনি মাদারীপুর সফরে এসেছিলেন। স্বভাবতই কবি নবীন সেন প্রশাসক হিসেবে গুরুজনস্থানীয় বিদ্যাসাগরকে বিশেষ যত্ন করে রেখেছিলেন ও সঙ্গ দিয়েছিলেন। লোকশ্রুতি হলো, বিদ্যাসাগর পার্শ্ববর্তী জনপদের নদীটি দেখে দামোদরের কথা স্মরণ করেন এবং তাতে পাড়ি দেওয়ার গল্পও করেন। বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রশাসক নবীন সেন এলাকার নাম রাখেন দামোদর, যা পরে লোকমুখে বিকৃত হয়ে আজকের ডামুড্যা রূপ ধারণ করেছে। প্রায় ৩৬ বছর সরকারি চাকরি সম্পন্ন করে ১ জুলাই ১৯০৪ সালে নবীনচন্দ্র সেন অবসরে যান। এর মাত্র পাঁচ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়।

৩.

নবীনচন্দ্র সেন কিশোরকাল থেকেই কাব্য রচনা শুরু করেছেন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘পাখির যেমন গীতি, সলিলের যেমন তরলতা, পুষ্পের যেমন সৌরভ, তেমনি কবিতানুরাগ আমার প্রকৃতিগত ছিল। কবিতানুরাগ আমার রক্তে–মাংসে, অস্থিমজ্জায়, নিশ্বাস–প্রশ্বাসে আজন্ম সঞ্চারিত হইয়া অতি শৈশবেই আমার জীবন চঞ্চল, অস্থির, ক্রীড়াময় ও কল্পনাময় করিয়া তুলিয়াছিল।’ আমাদের মনে হয়, এই স্বভাবকবিত্বের চাঞ্চল্য ও আবেগপ্রবণতা তাঁকে কাব্যের গঠন ও সৌষ্ঠব নির্মাণে সময় ব্যয়ের সুযোগ দেয়নি। তাই হয়তো তাঁর অসংযত ভাবোচ্ছ্বাসের ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন সাহিত্য সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত অধ্যাপক ও ইতিহাসকার ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক বাক্যই লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পূর্বে যদি কারও কবিতায় যথার্থ পাশ্চাত্য ধরনের লিরিকের স্বাদ পাওয়া যায়, তবে তার কিছুটা নবীনচন্দ্রের মধ্যেই পাওয়া যাবে।’

তবে এই অগ্রজ কবি তাঁর অনুজ এবং ভাবীকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবিকে যে তাঁরই সদ্য যুবা বয়সে চিনতে পেরেছিলেন, সেই ঘটনা নবীন সেনের বয়ানে উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করব। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার কাছে ন্যাশনাল মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল এবং বন্ধুর সঙ্গে তা দেখতে গিয়েছিলেন তরুণ নবীনচন্দ্র সেন। তখন তিনি সরকারি চাকুরে এবং ছুটিতে কলকাতায় বেড়াতে এসেছিলেন। এর মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং কলকাতার রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হওয়ায় তাঁর খ্যাতিও শিক্ষিতমহলে কম ছিল না। এ সময় এক সদ্য পরিচিতি বন্ধু তাঁকে হাত ধরে এক গাছতলায় নিয়ে যান। পরের বর্ণনা নবীন সেনের লেখা থেকেই জানা যাক। ‘দেখিলাম সেখানে সাদা ঢিলা ইজার চাপকান পরিহিত একটি সুন্দর নব-যুবক দাঁড়াইয়া আছেন। বয়স ১৮/১৯; শান্ত, স্থির। বৃক্ষতলায় যেন একটি স্বর্ণমূর্তি স্থাপিত হইয়াছে। বন্ধু বলিলেন, “ইনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ।” তাঁহার জ্যেষ্ঠ জ্যোতিরিন্দ্র নাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। দেখিলাম সেই রূপ, সেই পোশাক। সহাসিমুখে করমর্দনকার্যটা শেষ হইলে, তিনি পকেট হইতে একটি নোটবুক বাহির করিয়া কয়েকটি গীত গাহিলেন ও কয়েকটি কবিতা গীতকণ্ঠে পাঠ করিলেন। মধুর কামিনী লাঞ্ছন কণ্ঠে এবং কবিতার মাধুর্য ও স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভায় আমি মুগ্ধ হইলাম। তাহার দুই-একদিন পরে বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে তাঁহার চুচুড়ার বাড়িতে লইয়া গেলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, আমি নেশনাল মেলায় গিয়া একটি অপূর্ব নব-যুবকের গীত ও কবিতা শুনিয়াছি, আমার বিশ্বাস তিনি একদিন একজন প্রতিভাসম্পন্ন কবি ও গায়ক হইবেন। অক্ষয়বাবু বলিলেন, “কে? রবিঠাকুর বুঝি? ও ঠাকুরবাড়ির কাঁচামিঠে আম।” তাহার পর ১৬ বত্সর চলিয়া গিয়াছে। আজ ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ। আমার ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হইয়াছে।’

একজন প্রকৃত কবিই স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভার প্রকৃত সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে সক্ষম।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক