বাঘা-দৌলতপুর চরে এবার ‘রশিদ বাহিনী’

রাজশাহীর বাঘা ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা—এই দুই উপজেলার মাঝখানে কোথাও পদ্মা নদী, আবার কোথাও নদীর চর। সংযুক্ত এই চরের কিছুটা নাটোরের লালপুর উপজেলার মধ্যেও পড়েছে।

পদ্মা নদীর ওই বিস্তীর্ণ চরে প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের বাস। নদী ভাঙলে, তারা এক চর থেকে আরেক চরে যায়। বহুদিন আগে থেকে বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও পাবনার মানুষ এসে এই চরে বসতি স্থাপন করে। চরের উর্বর পলিমাটির ফসলের নেশায় তারা চর ছাড়ে না।

বছর পনেরো আগে এই চরে পান্না ও লালচান বাহিনীর উত্থান ঘটে। তারা প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারা শুরু করে। তাদের ফসলের হিস্যা না দিয়ে চরের মানুষ জমির ফসল ঘরে তুলতে পারতেন না। বছর দশেক আগে পান্না ও লালচান বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপর শান্তিতে ছিলেন এলাকাবাসী। এবার সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ‘রশিদ বাহিনী’।

নিজের আপন ভাই ও দুই চাচা খুন হওয়ার পর পান্না বাহিনীর ২৭ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বাঘা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে স্বপন। তিনি বলেন, ২০০২–০৮ সালের মধ্যে এই বাহিনীর হাতে চর এলাকার ৪২ জন খুন হন। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এনকাউন্টারে ও মানুষের গণপিটুনিতে তাঁর মামলার ১৯ আসামি নিহত হয়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আবার দিনের বেলায় বাঘার চৌমাদিয়ার চরে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বের করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, রশিদ বাহিনী সেদিন এক নারীসহ চারজনকে গুলি করে। ওই চারজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রহমান বাদী হয়ে বাঘা থানায় একটি মামলা করেন। সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে গত ৫ মার্চ ওই চরে রাজশাহী থেকে সাংবাদিক নিয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

এ ঘটনার জেরে ২৪ মার্চ রাত সাড়ে নয়টার দিকে ইব্রাহিম দেওয়ান (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়ে নদীর ধারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে এই চরে আবার অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। হত্যা মামলাটির বাদী হয়েছেন ইব্রাহিম দেওয়ানের বড় ভাই চৌমাদিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান দেওয়ান। দুটি মামলাতেই আবদুর রশিদকে প্রধান আসামি করা হয়। প্রথম মামলার পর বাঘা থানার পুলিশ রশিদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ফেনসিডিল, বিজিবির এক সেট ইউনিফর্মসহ তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে। বাঘা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল বারী রশিদের বাসা থেকে এসব জব্দ করার কথা স্বীকার করেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, পুলিশ এলেই রশিদ বাহিনীর লোকজন ভারতের সীমানার মধ্যে ঢুকে যান। তাঁরা এখন অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করেন। প্রয়োজনে বিজিবির পোশাক পরেন।

বাঘার চকরাজাপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, পান্না বাহিনী ও লালচান বাহিনীর পর এবার নতুন করে রশিদ বাহিনী সক্রিয় হয়েছে। বাঘা থানার চকরাজাপুর, দৌলতপুর থানার চিলমারি ও রামকৃষ্ণপুর এবং নাটোরের বিলমাড়িয়া ও লালপুর ইউনিয়ন (আংশিক) মিলিয়ে চরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের বাস। এর আগে পান্না ও লালচান বাহিনী তাদের জিম্মি করেছিল। এবার রশিদ বাহিনী তৎপরতা শুরু করেছে।

গত ২৫ মার্চ পদ্মা নদী পার হয়ে চৌমাদিয়ার চরে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়েই রশিদের বাড়ি। চারদিকে সুনসান। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল কোথাও কেউ নেই। ঘরের দরজা শুধু ভেজানো। তালা লাগানো নেই। নলকূপটা নষ্ট। রান্নাঘরের চুলাটাও মনে হলো অনেক দিন জ্বালানো হয়নি। তবে মুরগির খোপে একটি মুরগি রয়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে।

বাড়ির পাশে শুধু একটি বাথান রয়েছে। বাথানমালিক আবদুর রহিম বললেন, রশিদের আসল বাড়ি পাকশিতে। সেখানে তাঁর এক স্ত্রীর দুই সন্তান রয়েছেন। নতুন আরেকটি বিয়ে করে তিনি গত এক বছর আগে এখানে বাড়ি করেছেন।

চৌমাদিয়া বাজারটি বাঘা থানার ভেতরে। বাজারে দক্ষিণ পাশের সীমানা ঘেঁষেই দৌলতপুর উপজেলার উদয়নগর গ্রাম। বাজারে দুই গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছেন। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। বাজারের সঙ্গেই চৌমাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চৌমাদিয়ার আবুল গাজী বলেন, এই বিদ্যালয়ের পেছনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁরা চারজন গল্প করছিলেন। সেখান থেকে রশিদের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর লোকজন ইব্রাহিমকে তুলে নিয়ে পদ্মা নদীর ধারে গুলি করে হত্যা করে। এই মামলার দুই নম্বর আসামি দিলা ব্যাপারীকে পুলিশ কুষ্টিয়ার বারোমাইল এলাকা থেকে গত ২৯ মার্চ গ্রেপ্তার করে।

দৌলতপুরের চিলমারীর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ আহাম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাঘা ও দৌলতপুরের চরের মানুষ মিলেমিশে থাকে। দুষ্কৃতকারীরা যাতে এলাকায় না ঢুকতে পারে, সে জন্য তাঁরাও কাজ করছেন। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ওই এলাকায় একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা জরুরি।