বাজিতপুরে ১১টি ইউপির চারটিতেই নৌকার প্রার্থী সাংসদের আত্মীয়

কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সাংসদ আফজাল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

১১টি ইউনিয়ন নিয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা। এর সব কটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন হবে দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১১ নভেম্বর। ১১টি ইউপির ৪টিতেই স্থানীয় সাংসদ আফজাল হোসেনের আত্মীয়রা নৌকার টিকিট পেয়েছেন। ফলে উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাংসদের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্র কায়েমের অভিযোগ করেছেন অনেকে। অভিযোগ রয়েছে, বিরোধী মতের কেউ হলেই তাঁর ওপর হামলা-মামলা-ভয়ভীতি দেখানোর, তা তিনি নিজ দলের হোক বা হোক ভিন্ন দলের।

উপজেলার হালিমপুর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন উমর ফারুক। তিনি কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সাংসদ আফজাল হোসেনের শ্যালক। বলিয়ারদী ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কাসেম। তিনি সাংসদ আফজালের ভাগনে। এই দুই ইউপিতেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় সাংসদের শ্যালক ও ভাগনে ইতিমধ্যে বিনা ভোটে জয় পেয়ে গেছেন।

উপজেলার দিলালপুর ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন গোলাম কিবরিয়া। তিনি ওই ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান এবং সাংসদের মামাতো ভাই। এ ছাড়া গাজিরচর ইউপিতে নৌকা পেয়েছেন সাংসদের আরেক ভাগনে মো. জুয়েল মিয়া। তিনিও বর্তমান চেয়ারম্যান। পরের এই দুজনের ভাগ্য প্রথম দুজনের মতো অবশ্য অত সুপ্রসন্ন হয়নি। বিনা ভোটে জয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী।

দিলালপুর ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন মিজবাহ উদ্দিন খান। তিনি আবার সাংসদেরই আপন ফুফাতো ভাই। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আপন মামাতো ভাই গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা না বলে একে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ বলাই শ্রেয়তর। দুজনই সাংসদের আত্মীয় হয়েও দুজনে সম্পর্ক এতটাই আদায়-কাঁচকলায় যে বিদ্রোহী প্রার্থী এলাকাতেই যেতে পারছেন না। গেলেই বাড়িঘর ভাঙচুর হবে, জীবনের ওপর ঝুঁকি বেড়ে যাবে বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন বিদ্রোহী মিজবাহ উদ্দিন খান।

সাংসদ আফজাল হোসেনের বাড়ি বাজিতপুর। তিনি টানা তিনবারের সাংসদ। সেই সঙ্গে তিনি ওই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের অভিযোগ করেছেন অনেকে।

গোলাম কিবরিয়া এর আগেরবারও নৌকার মনোনয়ন নিয়ে জয় পেয়েছেন। সেবারও মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান মিজবাহ। তবে ২০১১ সালের নির্বাচনে জয় পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

গাজিরচর ইউপিতে সাংসদের ভাগনে জুয়েলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন দুজন। একজন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুল হক, অন্যজন দলের কর্মী আক্কাস মিয়া। তাঁরা দুজনই দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন। দল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের অনুরোধেও সাড়া দেননি দুজন।

মামাতো ভাই বনাম ফুফাতো ভাই দ্বন্দ্ব

সাংসদ আফজাল হোসেনের বাড়ি বাজিতপুর। তিনি টানা তিনবারের সাংসদ। সেই সঙ্গে তিনি ওই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। ফুফাতো ভাই মিজবাহ তাঁর চেয়ে বয়সে বড়। মিজবাহ উপজেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। সাংসদের মামাতো ভাই গোলাম কিবরিয়া দলের একজন সক্রিয় কর্মী। দুই প্রার্থীর বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে আগ থেকে দুজনের মধ্যে বিরোধ ছিল। এই অবস্থায় আগের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মামাতো ভাইয়ের দিকেই ঝুঁকে পড়েন সাংসদ। এরপর থেকে সাংসদের কোনো কথা না মেনে উল্টো অবস্থান নেন মিজবাহ। সেই থেকেই সাংসদের সঙ্গে মিজবাহের দূরত্ব বাড়তে থাকে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে মিজবাহ ১০টি মামলার আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে ৯টি হয়েছে থানায়, একটি আদালতে। একবার হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফেরেন। বর্তমানে তিনি সব কটি মামলায় জামিনে রয়েছেন।

বাজিতপুর উপজেলার দিলালপুর ইউপি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া (বাঁয়ে) এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মিজবাহ উদ্দিন খান (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

ভোটাররা জানান, দিলালপুর ইউপিতে নৌকার প্রার্থী গোলাম কিবরিয়াকে এলাকায় প্রচার-প্রচারণায় ভালোই দেখা যাচ্ছে। উল্টো দিকে, মনোনয়নপত্র জমার আগ থেকেই মাঠ থেকে অদৃশ্য রয়েছেন বিদ্রোহী মিজবাহ। প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ভয়ে মিজবাহ এখন পর্যন্ত ভোট চাইতে নির্বাচনী এলাকায় ঢুকতে পারেননি। তিনি এখন এলাকার বাইরে চলাফেরা করে সময় পার করছেন।

যোগাযোগ করা হলে মিজবাহ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু ছোট ভাইয়ের (সাংসদ) বিশ্বস্ত হতে পারলাম না বলেই আজ আমি এলাকার বাইরে। ভোট চাইতে ভোটারদের কাছে যেতে পারছি না। গেলেই বাড়িঘর ভাঙচুর হবে। জীবনের ওপর ঝুঁকি বেড়ে যাবে।’

দুই পক্ষের মধ্যে সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ৭ জুন। নির্বাচন সামনে রেখে ওই দিন মিজবাহ উদ্দিনের সমর্থকেরা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। ওই সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মিজবাহ উদ্দিনের পক্ষের মজিবুর রহমান (৬০) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। পরে গোলাম কিবরিয়াকে এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি করা হয়। এর পর থেকে দুজনের বিরোধ আরও বড় হয়। দিলালপুর ইউপির বাসিন্দারা এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হামলা-মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন।

দলের কাছ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন মিজবাহ। তবে নিজে গিয়ে নয়, সমর্থকদের দিয়ে জমা দেন। তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। পরে তিনি নির্বাচন কমিশনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পান। তবে নির্বাচনীয় প্রচারণায় এক দিনও মিজবাহর দেখা পাননি ভোটাররা।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারণায় না থাকার বিষয়ে নৌকার প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মিজবাহ দাঙ্গাবাজ, প্রতারক। সর্বশেষ বিবাদ বাড়িয়ে তিনি কয়েক শ বাড়িঘর ভাঙচুর করিয়ে লুটপাট করেছেন। গরু লুট করেছেন শতাধিক। সুতরাং, এমন একজন দাঙ্গাবাজ এলাকায় কেন আসেন না, সেই খবর তাঁর জানার কথা নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আফজাল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (মিজবাহ) আমার বড় ভাই বটে। তবে মানুষ ভালো না, দ্বিমুখী, দুষ্ট। আমার কথা শোনে না।’ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তিনি এলাকায় আসতে পারছেন না প্রশ্নে সাংসদ হেসে বলেন, তিনি (মিজবাহ) এলাকায় এলে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কেন এবং কোনো মতলবে আসছেন না, সেটা তিনিই ভালো বুঝবেন।

চার আত্মীয়ের নৌকা পাওয়ার বিষয়ে আফজাল হোসেন বলেন, ‘যোগ্য লোকদের নৌকা দেওয়া হয়েছে। এখানে কে আত্মীয় আর কে আত্মীয় নন, সেটি বিবেচনায় আনা হয়নি।