বাধা ডিঙিয়ে নৃত্যগুরু

‘নৃত্য ও বৃন্দ নাচসহ বুলবুলকৃত নৃত্যনাট্য ৮২টি। নাচে তিনি একাধারে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রা, রস ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে তুলে এনেছেন প্রাচীন বাংলার টেরাকোটা ও মন্দিরগাত্রের নৃত্য অভিব্যক্তি। বাংলার লৌকিক নৃত্যের চিরায়ত ভাব এবং রস অনিবার্যভাবে ধরা পড়েছে তাঁর নৃত্যে।

বুলবুল চৌধুরী

বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৫ বছর (১৯১৯-১৯৫৪)। এই অল্প সময়ের মধ্যে চিত্রকলা, নাটক, নৃত্য, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠান করে কুড়িয়েছেন শিল্পীখ্যাতি। ব্রিটিশ-ভারত ও পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নাচের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির পেছনে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। কিন্তু যৌবন না ফুরাতেই মরণব্যাধি ক্যানসার জীবনপ্রদীপ কেড়ে নেয় প্রতিষ্ঠিত এই শিল্পীর। মৃত্যুর আগে অর্থকষ্টে জর্জরিত এই গুণী শিল্পী পরিবারের কাউকেও কাছে পাননি। নিজ দেশেও হয়নি আজও তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন।

বলছিলাম নৃত্য পরিচালক, নির্দেশক ও শিক্ষক বুলবুল চৌধুরীর কথা। তাঁর প্রকৃত নাম রশিদ আহমদ চৌধুরী। রশিদ আহমদ চৌধুরী জন্মের পর তাঁর বাবার দেওয়া নাম। ডাকনাম ছিল টুনু। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় তিনি বাবার দেওয়া নাম পাল্টে নিজেকে পরিচিত করেন বুলবুল চৌধুরী নামে।

বুলবুল চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার (তৎকালীন সাতকানিয়া থানা) চুনতি গ্রামে। তাঁর বাবা পুলিশ কর্মকর্তা আজমত উল্লাহ চাকরিস্থল বগুড়ায় থাকাকালে ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি সেখানেই জন্ম বুলবুল চৌধুরীর। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়াও করেছেন সেখানে। এরপর পরিবারের সঙ্গে হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া প্রভৃতি স্থান বদল করে মানিকগঞ্জ জিলা স্কুল থেকে চার বিষয়ে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৩৪ সালে। ওই বছরই মাধ্যমিকে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৩৮ সালে স্নাতক পাস করেন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং ১৯৪৩ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

১৯৩৮ সালে স্নাতক পাস করার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নৃত্য পরিবেশন, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক জগতের তারকা হিসেবে স্থান করে নেন বুলবুল। ইতিমধ্যে তিনি দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও চর্চার লক্ষ্যে কলকাতায় গড়ে তোলেন ‘কলকাতা কালচারাল সেন্টার’ ও ‘ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন’ (ওফা)। ওফার সভাপতি ছিলেন ডা. জে এম জুডা এমডি, সহসভাপতি ছিলেন শ্রীমতী হেমলতা মিত্র এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শ্রীজ্ঞান মজুমদার। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বুলবুল চৌধুরী।

‘নৃত্য ও বৃন্দ নাচসহ বুলবুলকৃত নৃত্যনাট্য ৮২টি। নাচে তিনি একাধারে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রা, রস ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে তুলে এনেছেন প্রাচীন বাংলার টেরাকোটা ও মন্দিরগাত্রের নৃত্য অভিব্যক্তি। বাংলার লৌকিক নৃত্যের চিরায়ত ভাব এবং রস অনিবার্যভাবে ধরা পড়েছে তাঁর নৃত্যে।

বুলবুল চৌধুরী তাঁর সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে কলকাতাকে বেছে নিলেও তিনি তাঁর নাচের দল নিয়ে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলেও অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৯৫০ সালের ২২-২৯ জানুয়ারি বন্যার্তদের সাহায্যার্থে চট্টগ্রামে নাচের অনুষ্ঠান করে তাঁর দল। কিছুদিন পর ইরানের শাহের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় এবং পরে সিলেট, বরিশাল, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহীতে নৃত্য প্রদর্শন করেন তিনি। ১৯৫০ সালের মার্চের শেষে তিনি দলবলসহ করাচি যান। করাচিতে মোল্লাদের ফতোয়ার কারণে প্রথম দিকে তাঁর অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হলেও ৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত ১১টি অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং প্রশংসিত হন। এর আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নৃত্যকে তিনি পেশা হিসেবে নেবেন এবং পাকিস্তানের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে ভূমিকা রাখবেন। এ লক্ষ্যে পাকিস্তানের নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছিলেন। এ পর্যায়ে তাঁকে জাতীয় শিল্পী ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার।

বুলবুল চৌধুরী নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও তাঁর মধ্যে ছিল সাহিত্য প্রতিভাও। ছড়া-কবিতা দিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু স্কুলবেলায়, মাধ্যমিকে পড়ার সময়। গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। অজয় কুমার ছদ্মনামে ছড়াও লিখেছেন।

দেশের সীমা পেরিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও নৃত্য পরিবেশন করে প্রশংসিত হয়েছিলেন বুলবুল চৌধুরী। বুলবুলকন্যা নার্গিস বুলবুলের এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ১৯৫৩ সালে প্রথম বিদেশ সফরের সুযোগ পান বুলবুল চৌধুরী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বুলবুলের দল নৃত্য পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করে। এসব নৃত্যের মধ্যে ছিল ক্লে চার্মার, মুনলাইট সোনাটা, রূপক, ফিশারম্যান, সুর ও ছন্দ, চাঁদ সুলতানা, মন্বন্তর ইত্যাদি।

নানা কারণে অল্প সময়ের জীবনটার নানা পর্যায়ে আর্থিক অনটনে করুণ অবস্থায় কেটেছে বুলবুল চৌধুরীর। মৃত্যুর আগে তাঁর চিকিৎসা খরচ এমনকি সমাধি দেওয়ার খরচও চলেছে অন্যের সহযোগিতায়। বাবা-মায়ের সম্পর্কের আত্মীয়দের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য–সহযোগিতা তিনি বা তাঁর সন্তানেরা পাননি।

বুলবুল চৌধুরী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর টাটা এয়ারক্র্যাফটে যোগ দিয়েছিলেন অফিসার হিসেবে। কিন্তু নৃত্যজগতের মায়ায় একপর্যায়ে চাকরিটি ছেড়ে দেন। ১৯৪৬ সাল থেকে আর্থিক অনটনে পড়েন তিনি। তাঁর বাবা মারা যান ৪৭ সালের ২২ জুলাই। মনের জোরে কলকাতার বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। এ পর্যায়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় বুলবুলের।

নার্গিসের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, কলকাতায় পিজিয়ন নামে একটি সেলুন ছিল বুলবুল চৌধুরীর। ইউরোপে যাওয়ার সময় সেটির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যান তাঁর এক বন্ধু ও সেলুনের ম্যানেজার নীলরতনকে। ইউরোপ থেকে ফেরার সময় ভেবেছিলেন, সেলুনের আয় দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাবেন। কিন্তু এসে দেখেন, সেই বন্ধু সেলুনটি অন্য এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। নার্গিসের মতে, এটি ছিল বুলবুলের জীবনে প্রথম আঘাত। অন্যদিকে তখন তাঁর নাচ বা অন্য কিছু করার অবস্থাও ছিল না। কারণ, প্যারিসে একদিন গোসল করতে গিয়ে বাথটাব থেকে উঠতে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পান তিনি। প্যারিস থেকে সুইজারল্যান্ডে আসার পর সেখানকার চিকিৎসক তাঁকে একটি স্টিলের জ্যাকেট পরিয়ে দেন মেরুদণ্ড সোজা থাকার জন্য। দেশে এসে কিছুদিন ইনজেকশন দিয়ে তেমন ফল না পাওয়ায় জ্যোতি বসু ও হরিনারায়ণ বাবুর পরামর্শে তাঁকে ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভর্তি করা হয় কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে। হাসপাতালের সব খরচ বহন করেছিলেন হরিনারায়ণ ও স্নেহাংশু আচার্য।

পরিবারের অসহযোগিতা সম্পর্কের নার্গিস বুলবুল বলেন, ‘আব্বা অসুস্থ হওয়ার পর তিনি নিজেই টেলিগ্রামে ছোট চাচা মোস্তাক আহমদ (পেয়ারা চাচা) এবং পরে ফুফাকে জানিয়েছিলেন। আব্বা তাঁদের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য তিনি পাননি।’ নার্গিস জানান, ১৭ মে বুলবুল চৌধুরী মারা যাওয়ার পর হরিনারায়ণ ও বুলবুলের শাশুড়ি তাঁর সমাধি দেওয়ার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে বুলবুলের সব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁদের স্ত্রী-সন্তান এবং শ্বশুরবাড়ির সবাই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর ’৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে আফরোজা বুলবুল ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। চেষ্টা–তদবির করে ওয়াইজঘাট এলাকায় নবাবদের একটি পুরোনো বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালের ১-৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বুলবুল স্মৃতি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।

এতে বাণী দিয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বেগম রানা লিয়াকত আলী (প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের স্ত্রী) খানের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ওই বছর ১৭ মে বুলবুলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আফরোজা ও বুলবুলের বন্ধু মাহমুদ নুরুল হুদার উদ্যোগে ঢাকায় ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিক্ষার্থী ও পরিচালনা কমিটির কিছু সদস্যের সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পেরে ’৫৫ সালের সেপ্টেম্বরেই সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় চলে যান আফরোজা। সেখান থেকে ’৫৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বুলবুল ইনস্টিটিউট অব কালচার (বিআইসি)’।

মুহাম্মদ শামসুল হক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া