বাবা চকলেট নিয়ে আসবেন, জুনায়েদের এই অপেক্ষা আর শেষ হবে না

মা আফরোজা খাতুনের কোলে শিশু জুনায়েদ। গতকাল বুধবার মাগুরা সদর উপজেলার ইছাখাদায়
ছবি: প্রথম আলো

দুই বছরের জুনায়েদের চকলেট খুব পছন্দ। কাজ থেকে ফেরার পথে বাবা তার জন্য চকলেট নিয়ে আসতেন। শেষ যেদিন বাবা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন, সেদিনও চকলেট আনতে বলেছিল সে। দুই সপ্তাহ হতে চলল বাবা আজিজুর রহমান (৩০) এখনো ফিরে আসেননি। সময়ের হিসাব না বুঝলেও বাবার অপেক্ষা ঠিকই করছে শিশু জুনায়েদ। আর মায়ের কান্না দেখে কাঁদছে জুনায়েদও।

৬ জুন সকালে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কালুকান্দি গ্রামের একটি রাস্তার পাশে ও মজাপুকুর থেকে দুটি বস্তায় মোড়ানো অবস্থায় মাথাবিহীন মরদেহের খণ্ডিত দুটি অংশ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি আজিজুরের বলে শনাক্ত করে তাঁর পরিবার। মাগুরা সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকতেন তিনি। মৃত্যুর পর সন্তানকে নিয়ে সদর উপজেলার ইছাখাদা পুরাতন বাজার এলাকায় বাবার বাড়ি ফিরে গেছেন স্ত্রী আফরোজা খাতুন (১৮)।

পাঁচ বছর আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আজিজুরের সঙ্গে বিয়ে হয় আফরোজার। দুই বছর আগে তাঁদের সন্তান হয়। আজিজুর একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে (এমএলএম) চাকরি করতেন। যেখানে বায়ো স্প্রে জাতীয় পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর নির্ভর করত মাসিক আয়–রোজগার। সচ্ছলতা না থাকলেও যা আয় হতো, তাতে সুখেই ছিলেন এই দম্পতি। আজিজুর নিহত হওয়ায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে স্ত্রী আফরোজার মাথায়।

আফরোজা জানান, ঘটনার দিন সকালে তাঁরা একসঙ্গে খাবার খান। আজিজুর বের হওয়ার সময় ছেলে দৌড়ে গিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলেছিল, ‘বাবা চক্কেট আনবা।’ জবাবে আজিজুর দুপুরেই চকলেট নিয়ে ফিরে আসতে চান। শহরে গিয়ে ছেলেকে ভিটামিন এ খাওয়ানোর বিষয়ে মনে করিয়ে দিতে স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন আজিজুর। ওটাই স্বামী–স্ত্রীর শেষ কথা।

আফরোজা বলেন, ‘প্রতিদিনের আয়ের টাকায় চলত আমাদের সংসার। কোনো সঞ্চয় ছিল না। তবে ভালোই ছিলাম। কিন্তু এক দিনেই শূন্য হয়ে গেছি। ছেলেকে একটা চকলেট কিনে দেব, সেই পয়সাটাও নেই।’ এখন কীভাবে ছেলেকে নিয়ে চলবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না মাধ্যমিক পাস করা এই গৃহবধূ।

নিহত আজিজুরের বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার সংকোচখালী গ্রামে। তবে খুব অল্প বয়সে মা–বাবা মারা যাওয়ার পর মহম্মদপুর উপজেলার বানিয়াবহু গ্রামে নানা আবুল কাশেমের বাড়িতে থেকে বড় হয়েছেন তাঁরা চার ভাইবোন। আজিজুরের শ্বশুর আলমাস শেখ ইছাখাদা এলাকায় কাঠ চেরাই করা একটি করাতকলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এখন তাঁর আশ্রয়েই আছেন আজিজুরের স্ত্রী–সন্তান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আর কোনো সন্তান নেই। আজিজুর আমার ছেলের মতো ছিল। সে যেমন অল্প বয়সে মা–বাবা হারিয়েছিল। এখন তাঁর সন্তানও বাবাহারা। তাঁর এই দুই বছরের শিশুসন্তানকে যে এতিম করে দিল, সে যেন ছাড়া না পায়।’ আলমাস শেখ জানান, তিনি নিজেও অসুস্থ। দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। কাজ করলে আয়, না করলে নেই। এমন পরিস্থিতিতে মেয়ে ও নাতিকে কীভাবে চালাবেন, তার কিছুই জানেন না তিনি।

নিহত আজিজুরের ভাই হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, জমিজমা বলতে তাঁদের তেমন কিছুই ছিল না। বাবার বাড়িতে আট শতাংশের মতো জমি ছিল। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ বিক্রি করতে হয়েছে তাঁর চাকরির জন্য। এখন কবরস্থানের জন্য তিন শতক জমি অবশিষ্ট আছে তাঁদের। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত হাবিবুর বলেন, ‘ভাই যেহেতু মারা গেছে, তাঁর ছেলেকে তো আমাদেরই দেখতে হবে। যতটুকু পারি করব।’

বাবা আজিজুরের সঙ্গে শিশু জুনায়েদ
ছবি: সংগৃহীত

আজিজুর নিহতের ঘটনায় ৬ জুন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মহম্মদপুর থানায় হত্যা ও লাশ গুমের মামলা করেন হাবিবুর রহমান। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গত সোমবার দুপুরে যশোরের শার্শা থেকে মো. আশরাফ আলী (৩৩) নামের এক যুবককে আটক করে র‍্যাব-৬। তাঁরই দেওয়া তথ্য অনুসারে ওই দিন সন্ধায় মাগুরা সদর উপজেলার চাউলিয়া ইউনিয়নের ঘোড়ানাস গ্রামের মাসুদ ব্রিকস নামক ইটভাটার পাশে একটি কালভার্টের নিচ থেকে খণ্ডিত লাশের একটি পা উদ্ধার করে র‍্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একই জায়গা থেকে ২০–৩০ ফুট দূরত্বের মধ্যে মাথাটিও উদ্ধার করা হয়। গতকাল বুধবার হত্যার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর অভিযুক্ত ওই যুবককে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাগুরা সিআইডির পরিদর্শক নিকুঞ্জ কুমার কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, নিহত যুবকের ব্যবহৃত মুঠোফোন পাওয়া গেছে। তবে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও নিহত আজিজুরের মোটরসাইকেল এখনো উদ্ধার হয়নি। সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এই ঘটনায় আরও কেউ জড়িত ছিল কি না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন