‘বাবা, মোর একটা ঘর দরকার’

রংপুরের পীরগাছায় ভাঙা ঘরে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন এই দম্পতি। ১৫ দিন আগে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ইসমাইল হোসেনের বয়স ৭৩ ছুঁই ছুঁই। একসময় তাঁর কোনো অভাব ছিল না। ছিল বাড়ি, আবাদি জমি আর শরীরের তাগত। আজ এসব নেই। চার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে তিনি নিঃস্ব। শরীর কুলোয় না, ব্যথায় জর্জরিত দুহাত উঁচু করতে পারেন না।

ইসমাইল হোসেন পলিথিন ও চটের বস্তা দিয়ে তৈরি করেছেন একটি বসতঘর। তাও ছিঁড়েফিড়ে একাকার। আট বছর ধরে তিনি জীবনসঙ্গিনী মোমেনা বেগমকে (৬৩) নিয়ে ওই ঘরেই অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।

১৩ দিন ধরে রংপুরের ওপর দিয়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। সূর্যের মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। বিকেল থেকে শুরু হয় কুয়াশা। রাতে বৃষ্টির মতো পড়ছে ঘন কুয়াশা। বিদ্যমান থাকছে দুপুর পর্যন্ত। হিমেল বাতাসে তীব্র ঠান্ডায় সাধারণ মানুষ কুঁকড়ে গেছে। জনজীবন হয়ে পড়েছে জবুথবু। এমনি সময়ে ওই ভাঙা ঘরে দুর্দশার অন্ত নেই হতদরিদ্র বৃদ্ধ ইসমাইল ও তাঁর স্ত্রী মোমেনার। এই দম্পতির বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকসুদখাঁ গ্রামে।

সরেজমিনে কথা হয় ইসমাইল ও মোমেনার সঙ্গে। তাঁরা বলেন, তাঁদের বর্তমানে সম্বল পৈতৃকসূত্রে পাওয়া শুধু তিন শতক ভিটে ও চট-পলিথিনে ঘেরা টিনের ছাপড়া দেওয়া জরাজীর্ণ ঘরটি। মোমেনা বয়সের কারণে তেমন কাজকর্ম করতে পারেন না। ব্যথায় ইসমাইল হাত দুটো উঁচু করতে পারেন না। পেটের তাগিদে তবুও মাঝেমধ্যে বের হন লাকড়ি সংগ্রহে। বাজারে বিক্রি করে যা পান, তা দিয়ে খাবার কেনেন। শরীর না কুলালে বের হতে পারেন না। তখন কাটান উপোস। বর্তমানে রাতে বৃষ্টির মতো পড়া ঘন কুয়াশা ও হিমেল বাতাসের কারণে ঠান্ডায় জরাজীর্ণ ঘরে থাকাটা তাঁদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসমাইল হোসেন বলেন, তাঁর একটি টিনশেডের বাড়ি ছিল। তাঁর এক ছেলে ও চার মেয়ে। তিন মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে ৬৬ শতক আবাদি জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন। আট বছর আগে ছোট মেয়ের বিয়ের সময় প্রতিবেশী এক ব্যক্তির কাছে সুদের ওপরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় পাওনাদারের হাতে অপমানিত হয়েছেন। বাধ্য হয়ে তখন বসতবাড়িটি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে সুদে–আসলে পরিশোধ করেন। পরে তিন শতক পৈতৃক ভিটেয় পলিথিন চট ও বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি ঝুপড়ি ঘর তোলেন। তখন থেকে সেই ঘরে রাত যাপন করছেন স্ত্রীকে নিয়ে। অভাবের কারণে তখনই একমাত্র ছেলে মানিক মিয়া (২৩) তাঁদের ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। আর খোঁজ নেননি। চার মেয়ের স্বামী রিকশা চালান। তাঁরা স্বামী নিয়ে কেউ ঢাকায়, আবার কেউ পাবনায় থাকেন। তাঁরাও তেমন খোঁজ নেন না। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই ইসমাইলের। তিনি বলেন, ‘অভাবোত ওদেরে সংসার চলে না। হামাক আর দিবে কী।’ একপর্যায়ে ছলছল চোখে বলেন, ‘বাবা, হামার জেবন তো শ্যাষ। কষ্ট আর কত করি। তার চাইতে আল্লাহ হামাক দুই মাইষোক তাড়াতাড়ি দুনিয়া থাকি তুলি নেউক।’

ইসমাইল আরও বলেন, ‘বাবা, মোর একটা ঘর দরকার। এ্যাঙ্কা ঠান্ডাত খুব কষ্ট। হামরা বুড়া-বুড়ি মানুষ। ঠান্ডা আরও বেশি নাগে। ভাঙা ঘরটা দিয়া সরসর করি বাতাস ঢোকে। ছাপড়ার টিন দিয়া রাইতোত কুয়াশার পানি টপটপ করি গাওত পড়ে। নিন (ঘুম) হয় না।’

মোমেনা বেগম বলেন, ‘বাবা, হামার ভাগ্য খারাপ। বুড়ার (স্বামীর) জ্যাঠোর নাম আছিল মকসুদ খাঁ। অনেক আগোত মরি গেইচে। সেই জন্যে গ্রামের নাম হইচে মকসুদখাঁ। খুব ঠান্ডা শুরু হইচে বাবা। কম্বল গাওত দিয়াও ঠান্ডা পালায় না। রাইতোত টিন চুইয়া ঠান্ডা পানির টোপ যখন গাওত পড়ে, তখন চটকি উটি। হামার ভাঙা কপাল, ভাঙা ঘর। চায়া আছি কোন দিন আল্লাহ তুলি নেয়। কষ্ট থাকি বাঁচি।’

মকসুদখাঁ গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষার্থী শাকিল হোসেন বলেন, ‘ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কষ্টের শেষ নেই। তীব্র ঠান্ডায় ভাঙা ঘরে তাঁরা অসহায়ত্ব জীবন যাপন করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীন ও দুস্থ–অসহায় মানুষদের ঘরবাড়ি করে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের ভাগ্যে এখন পর্যন্ত ঘর জোটেনি। আমরাও তাঁদের জন্য কিছু করতে পারছি না।’

স্থানীয় কৈকুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, মকসুদখাঁ গ্রামের পাশে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করে সেখানে তাঁদের ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ সামছুল আরেফীন বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি বৃদ্ধ ইসমাইলের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁরা স্বামী–স্ত্রী আসলেই অনেক দৈন্যদশায় দিন যাপন করছেন। তাঁদের দুরবস্থা দেখে নিজেরও খারাপ লেগেছে। কিছুদিন আগে আমি তাঁদের দুটি কম্বল ও শুকনা খাবার দিয়ে এসেছি। উপজেলায় ২২০ জন গৃহহীনকে ঘর দেওয়া হলেও তালিকায় তাঁদের নাম ছিল না। ভবিষ্যতে বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের ঘরের ব্যবস্থা করে দেব।’