বাবা রিকশাচালক, এটা আমার কাছে গর্বের

জীবনে সাফল্য পেতে কার না ভালো লাগে, যদি সেই সাফল্য আসে অনেক কষ্ট আর শ্রমে! পড়াশোনার প্রতিটি ধাপে আমার যখনই একটা করে সাফল্য এসেছে, আমার সব কষ্ট মুছে গেছে। এক বেলা ভালো না খেতে পারার কষ্ট, টাকার অভাবে বাড়ি বাড়ি হেঁটে প্রাইভেট-টিউশনি করিয়ে পড়াশোনার খরচ জোটানোর কষ্ট। এসএসসিতে যখন ভালো ফলের খবর পেলাম, তখন আনন্দে চোখে জল ধরে রাখতে পারিনি। মনে হয়েছিল, এত বড় বিজয় কীভাবে অর্জিত হলো!

সেই আনন্দ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় সামনে কীভাবে পড়াশোনা চলবে, এই ভেবে। আবার শুরু হয় সংগ্রাম। সংগ্রাম করে করে এইচএসসিতেও ভালো ফল এল। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু হাল ছাড়িনি। টিউশনি চালিয়ে যাই। রাতদিন পড়াশোনা করে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম। মেডিকেলে চান্স পেলাম। সারা দেশ থেকে অসংখ্য ফোন, মানুষের শুভাশীষ, শুভেচ্ছা এল। সে কী ভালো লাগা! মানুষের এত ভালোবাসা, শুভকামনা আমাকে অভিভূত করেছে। এত কিছুর মধ্যেও অজানা অনিশ্চয়তা তাড়িয়ে বেড়ায় সব সময় কীভাবে কী করব ভেবে!

আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মানুষের এগিয়ে যাওয়ার জন্য দারিদ্র্য প্রধান সমস্যা নয়। পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও মনের জোর থাকলে কেউ কোনো দিনও হারে না। মনে পড়ে, আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, তখন সকালে মরিচ-লবণ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। দুপুরে বাড়িতে ফিরে ক্ষুধায় অস্থির লাগত। মা বলতেন, ‘তোর বাবা এখনো চাল-সওদা নিয়ে বাড়িতে ফেরেনি, তাই রান্না হয়নি।’ মা না খেয়ে সকালের ভাতটুকু তুলে রাখতেন আমাদের জন্য। আমাদের সেই ভাত আর পানি মিলিয়ে খেতে দিতেন। বাবা শেষ বিকেলে চাল-সওদা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরতেন। মা রান্না করতেন। সন্ধ্যার পরে দুমুঠো ভাত, সবজি, কোনো দিন কম দামের মাছ—এই ছিল আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা।

আমরা চার বোন পড়াশোনা চালিয়ে গেছি নিজেদের অদম্য ইচ্ছায়। দারিদ্র্য আমাদের থামাতে পারেনি। এতটুকু পথ আসতে যখনই কোনো প্রতিবন্ধকতা এসেছে, তখনই বাবার ঘামে ভেজা, জীর্ণ-শীর্ণ ক্লান্ত মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বিনা চিকিৎসায় মায়ের কষ্ট পাওয়ার ছবিটা চোখে ভাসত। তখন কোনো কষ্ট, গ্লানি, প্রতিবন্ধকতার দেয়াল আমার পথ আটকাতে পারেনি। এগুলোই আমার এগিয়ে চলার মূল অনুপ্রেরণা, শক্তি। আমার বাবা রিকশাচালক, এটা আমার কাছে গর্বের, অহংকারের।

টাকার অভাবে আমার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা হয়নি। তখনই আমার মনে জেদ চেপেছিল, আমি চিকিৎসক হব। আমি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি জেনে তাঁদের চোখ আনন্দে ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। তাঁদের এই আনন্দ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সেদিন আনন্দে মা–বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। সামনের দিনগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে চাই।

এমবিবিএস শেষ করে আরও পড়াশোনার ইচ্ছা আছে। আমার ইচ্ছা যদি পূরণ হয়, তাহলে আমি গরিব, অসহায়, দরিদ্র রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেব। জীবনের টানাপোড়েন, প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর সংগ্রাম আমার জীবনকে সেই বোধ দিয়েছে। জীবনবোধের শিক্ষা কখনো মানুষ ভোলে না, অস্বীকার করে না। এত দূর আসার পেছনে আমার পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আমি পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।

সাদিয়া আফরিন: রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নবীন শিক্ষার্থী

অনুলিখন: এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল