বালুচরে ডিঙি নৌকা, ঘরে কষ্টের জীবন

উপকূলে মাছ নেই। ‍রঙিন নৌকাগুলো পড়ে আছে বালুচরে। কক্সবাজারের টেকনাফ সৈকতের মহেশখালীয়াপাড়ায়ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে দক্ষিণ দিকে ৮৪ কিলোমিটার গেলে চোখে পড়ে নির্মাণাধীন টেকনাফের সাবরাং ট্যুরিজম পল্লি। পল্লির সামনে থেকে উত্তরে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া কয়েক কিলোমিটার বালুচরে পড়ে আছে শত শত রঙিন নৌকা। বিভিন্ন রঙে সাজানো এই নৌযানগুলোকে স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন ‘ডিঙি নৌকা’। গভীর সাগরে নয়, উপকূলের কাছাকাছি থেকে নৌকাগুলো মাছ ধরে আনে।

গতকাল রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভের মহেশখালীয়াপাড়া পয়েন্টে পড়ে আছে শতাধিক রঙিন নৌকা। সৈকত ঘুরতে আসা কয়েকজন রঙিন নৌকার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। রঙিন নৌকার সারি দূর থেকে দেখতে দারুণ। বাতাসে পতপত করে উড়ছে নৌকায় টাঙানো রঙিন নিশানা।  

কাছে গিয়ে দেখা গেল, নৌকাগুলোয় কোনো জেলে নেই। চার-পাঁচটা নৌকা পাহারা দিচ্ছেন একজন জেলে। অন্য জেলেরা ঘরে অবস্থান করছেন। বিশাল বঙ্গোপসাগরেও মাছ ধরার কোনো নৌযান চোখে পড়েনি। বিশাল সৈকতটাও নির্জন পড়ে আছে। গত ১ এপ্রিল থেকে সৈকতে লোকজনের সমাগম নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসন।

বালুচরে ডিঙি নৌকা ফেলে রাখার কারণ জানতে চাইলে স্থানীয় জেলে রমজান আলী (৩৮) বলেন, কিছুদিন ধরে সমুদ্রে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। লোকসান গুনতে গুনতে হয়রান নৌকার মালিক। তাই নৌকাগুলো বালুচরে তুলে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে চলছে লকডাউন। আয়রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই ডিঙি নৌকার হাজারো জেলের। অর্থসংকটে পড়ে কষ্টের জীবন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো।

উপকূলে মাছ নেই। ‍রঙিন নৌকাগুলো পড়ে আছে বালুচরে। কক্সবাজারের টেকনাফ সৈকতের মহেশখালীয়াপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিটি নৌকায় জেলে থাকেন পাঁচ থেকে সাতজন। জেলেদের দৈনিক মজুরি ৫০০-৭০০ টাকা। ৬০-৯০ কিলোমিটার দূরের গভীর সাগরে যেসব ট্রলার মাছ ধরতে যায়, তারা একটানা ১০-১৫ দিন সাগরে অবস্থান করে মাছ ধরে আনে। জেলায় বড় আকৃতির মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে অন্তত ছয় হাজার।

আর উপকূলের কাছাকাছি থেকে ছোট মাছ ধরার ডিঙি নৌকা আছে প্রায় দুই হাজার। এসব নৌকায় ধরা হয় লইট্যা, চিটকিরি, পোপা, ফাইষ্যা, চিংড়ি, সুন্দরী ইত্যাদি মাছ। দিনের বেলায় জাল ফেলে ধরা হয় মাছ। দিনের মাছ দিনেই বিক্রি হয় বালুচরে। মাছ ধরা শেষ হলে সন্ধ্যার আগে নৌকাগুলো ঠেলাগাড়িতে তুলে বালুচরে এনে রাখা হয়।
টেকনাফ উপকূলের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরাং, হারিয়াখালী, মহেশখালীয়াপাড়া, বড়ডেইল, বাহারছড়া, উখিয়ার পাটোয়ারটেক, ইনানী, রেজুখাল ও কক্সবাজারের দরিয়ানগর সৈকতে অসংখ্য রঙিন নৌকা পড়ে আছে।

টেকনাফের হারিয়াখালীর একটি নৌকার মালিক আবদুল জলিল বলেন, গত ১০-১৫ দিন ধরে সাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। মাছ ধরা না পড়লে প্রতিদিন একটি নৌকার বিপরীতে জেলে শ্রমিকদের মজুরি, জ্বালানিসহ মালিকের লোকসান হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। লোকসানের কারণে বহু নৌকার মালিক দাদন ও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না।

মহেশখালীয়াপাড়ার জেলে আবদুল আমিন বলেন, ‘আয়রোজগার না থাকায় ধারদেনায় চলেছে রোজার মাস। ঈদ কেটেছে অনেক কষ্টে। ঈদে স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়েকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিব দূরের কথা, ঠিকমতো দুইবেলা খাবারও জুটছে না।’

আরেকটি নৌকার জেলে রুহুল আমিন (৪৫) বলেন, ‘টানাপোড়েনে চলছে জেলেদের অমানবিক জীবন। ২০ মে থেকে শুরু হচ্ছে টানা ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞা। তখন কী হবে বুঝতে পারছি না। আয়রোজগারের বিকল্প কাজও এলাকায় নেই।’

মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার শহরের হাটবাজারগুলোতে সামুদ্রিক মাছের সংকট চলছে। জেলায় চাহিদার ৩৫ শতাংশ মাছ জোগান দেয় ডিঙি নৌকাগুলো। ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিপুল লইট্যা মাছ সরবরাহ হয় চট্টগ্রাম ও ঢাকার বাজারে।

টেকনাফ ডিঙি নৌকা মালিক সমিতির সভাপতি সুলতান আহমদ বলেন, সমিতির আওতায় প্রায় ২ হাজার নৌকায় মাছ ধরেন অন্তত ১২ হাজার জেলে। লকডাউন ও সাগরের মাছের সংকট নৌকার জেলে ও মালিকদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। অর্থসংকটে পড়ে ৯০ শতাংশ জেলে ঈদ করতে পারেননি। অনেকে দিনে এক বেলা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। ২০ মে থেকে ৬৫ দিনের মাছ ধরা বন্ধের যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে ১২ হাজার জেলের জীবন বিপন্ন হবে। ৬৫ দিনের সময়সীমা কমিয়ে ৪৫ দিনে আনা উচিত।

নৌকা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ গণি বলেন, মাছ আহরণ বন্ধ থাকলে সরকারিভাবে বেকার জেলেদের ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু ডিঙি নৌকার ১২ হাজার জেলে এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত বছর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় ত্রাণসহায়তা পেয়েছিলেন নিবন্ধিত ৪৮ হাজার ৩৯৩ জন জেলে। এবার অতিরিক্ত আরও ১৪ হাজার ৮০০ জন জেলেকে ত্রাণ সহায়তার জন্য নিবন্ধিত করা হয়েছে। এবারের ৬৫ দিনের মাছ আহরণ বন্ধে ত্রাণসহায়তা পাবেন ৬৩ হাজার ১৯৩ জন জেলে। প্রথম ধাপে ৪২ দিনের জন্য (২০-৩০ জুন) ৫৬ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে। এ জন্য ৩ হাজার ৫৩৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে টেকনাফের জেলেরা আছেন।