বালুচরে সবুজ তরমুজের হাসি

সাগরপাড়ের বালুচরে অনাবাদি জমিতে তরমুজের আগাম ফলনে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জাহাজমারা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
সাগরপাড়ের বালুচরে অনাবাদি জমিতে তরমুজের আগাম ফলনে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জাহাজমারা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সাগরপাড়ের বিস্তীর্ণ বালুচরে আগে কখনো ফসল ফলেনি। পতিত পড়ে থাকত। উপজেলার জাহাজমারা গ্রামের হাসি বেগমের পরিবারের চেষ্টায় সে বালুচরে এখন সবুজের সমারোহ। তরমুজে ভরে উঠেছে সেই নিষ্ফলা জমি। ফলন আর দাম হাসি ফুটিয়েছে হাসি বেগমের পরিবারের সদস্যদের মুখে।

জাহাজমারা গ্রাম উপজেলার মৌডুবি ইউনিয়নে। সাগরপাড়ের এ গ্রামে সরকারি একটা আবাসন প্রকল্পে থাকে হাসি বেগমের (৩৫) পরিবার। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আগে দিনমজুরের কাজ করলেও উপজেলা কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় হাসি বেগমের পরিবার এখন বালুচরে তরমুজের চাষ করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বালুচরে আগেও বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে গ্রামটিতে তরমুজ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।

হাসি বেগম জানান, এনজিও এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ৩ একর জমিতে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন তিনি। খেতেই ছাপড়া ঘর তৈরি করে স্বামী মো. ফারুক (৪২) ও ছেলে রাসেলকে (২৫) নিয়ে দিনরাত পরিচর্যা করেছেন। সাগরপাড়ের বালুতে তৈরি করেছেন গভীর কুয়া। সেখান থেকে মিষ্টি পানি তুলে সেচ দিয়েছেন তরমুজ খেতে।

হাসি বেগমের ৩ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করতে খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। আগাম আবাদ করায় খেতেও আগাম তরমুজ উঠেছে। এরই মধ্যে দুই লাখ ২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে।

হাসি বেগমের মতো জাহাজমারা গ্রামের সাগরপাড়ে এ বছর ২৫ জন কৃষক ৩৫ হেক্টর জমিতে আগাম তরমুজের চাষ করেছেন বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। রাঙ্গাবালী উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জুয়েল বলেন, পটুয়াখালী জেলার কৃষি অনেকটাই আমন চাষ নির্ভর। সাধারণত এলাকার কৃষক ডিসেম্বর মাসে আমন ফসল তোলার পর জানুয়ারি মাস থেকে তরমুজের আবাদ শুরু করেন। এপ্রিল মাসে খেত থেকে তরমুজ তুলে বাজারে বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু জাহাজমারা গ্রামে এই কৃষকেরা ডিসেম্বর মাসেই আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন। জাহাজমারা ছাড়াও এ বছর রাঙ্গাবালী উপজেলায় মোট ৭ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।

গত বুধবার সরেজমিনে জাহাজমারা সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, খেত থেকে তরমুজ তুলে জড়ো করছেন কৃষকেরা। স্তূপ করে রাখছেন বিক্রির জন্য। ঢাকা থেকে এসে কয়েকজন ব্যবসায়ী তরমুজ কিনে সৈকতের তীরে থাকা ট্রলারে বোঝাই করছেন।

এক খেতে সেচ দিতে দেখা গেল সুমন দালাল (২৮) নামের এক কৃষককে। তিনি জানান, এ বছর ১ একর ২০ শতাংশ জামিতে তরমুজের আবাদ করেছেন তিনি। এতে তাঁর ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এক লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরেক খেতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেচ দিচ্ছিলেন কৃষক ফারুক হাওলাদার (৩৫)। ফারুক জানান, পরের অনাবাদি জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। খেতের পাশে মাটি খনন করে বড় কুয়া তৈরি করেছেন। কুয়া থেকে পানি তুলে পরিচর্যা করেন।

তরমুজ কিনতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, গত মৌসুমে যে তরমুজ প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা কিনেছেন, সেই তরমুজ এখন ৮০ টাকা থেকে ১১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আগাম বাজারে তরমুজ ওঠায় চাহিদাও আছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, উপজেলায় রবি মৌসুমে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৩৫ হাজার ৭৭৭ হেক্টর। গত বছর রবি মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ৩২ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমিতে। অনাবাদি পড়ে ছিল ৩ হাজার ১৯৪ হেক্টর জমি। রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজমারা গ্রামে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পানির। কিন্তু কৃষকেরা কূপ খনন করে পানির সমস্যাও মিটিয়েছেন। যে জমিতে কোনো ধরনের ফসল হতো না, সেই পতিত জমিতেও এখন ফসল ফলছে। বালুচর হওয়ায় কৃষকদের সার্বক্ষণিক যত্ন নিতে হয়। সময় মেনে পানি দিতে হয়। প্রয়োজনীয় পানি দেওয়ার ফলে মাটিতে প্রচুর রস সৃষ্টি হয় যা তরমুজের বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। এ ছাড়া, দিনের বেলা প্রখর রোদে তরমুজের রং উজ্জ্বল হয়। কৃষকদের শ্রম আর প্রাকৃতিক পরিবেশের সমন্বয়েই সাগরপাড়ের বালুচর সবুজ হয়েছে।