বিচারকের অনন্য উদ্যোগ, ঠিকানাহীন ১২ শিশু মায়ের কোলে

দেশে এই প্রথম রাজশাহী সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের উদ্যোগে নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের সুযোগ পাচ্ছেন। গত তিন বছরে বিচারক আবু সাঈদের আদালতের মাধ্যমে পিতৃ-মাতৃহীন ১২টি শিশুকে নিঃসন্তান দম্পতিরা পেয়েছেন।

নবজাতকপ্রতীকী ছবি

শিশুটির চোখে রঙিন চশমা। পরিপাটি পোশাক। অনবরত মায়ের হাত ধরে টানছে। বাড়ি যাবে। তার এখানে ভালো লাগছে না। মা আমেরিকান দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা। এই মা-মেয়েকে দেখে কারও বোঝার উপায় নেই যে তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। বিয়ের পর এই মা ১১ বছর নিঃসন্তান ছিলেন। অবশেষে আদালতের মাধ্যমে রাজশাহীর ছোটমণি নিবাস থেকে আট মাস বয়সে এই শিশুটিকে দত্তক নেন। এখন তার বয়স চার বছর। এই মেয়েটিই এখন তাঁর পৃথিবী।

এই সুযোগ করে দিয়েছেন রাজশাহীর সদর সিনিয়র সহকারী জজ মো. আবু সাঈদ। দেশে এই প্রথম তাঁর উদ্যোগে নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও আদালতের ভাষায় এই মা-বাবা হচ্ছেন ‘আইনি অভিভাবক’। গত তিন বছরে আবু সাঈদের আদালতের মাধ্যমে পিতৃ-মাতৃহীন ১২টি শিশুকে নিঃসন্তান দম্পতিরা পেয়েছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত রাজশাহীর ছোটমণি নিবাসে এতিম, অসহায়, পরিত্যক্ত, হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন শিশুদের প্রতিপালন ও পুনর্বাসন করা হয়। সেখান থেকেই বাচ্চাদের নিঃসন্তান দম্পতিদের দেওয়া হচ্ছে।

শুধু সন্তানকে আইনি অভিভাবকের কাছে তুলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি বিচারক আবু সাঈদ। তিনি প্রতি তিন মাস পরপর এই শিশুদের আদালতে আনার নিয়ম করে দিয়েছেন। বিচারক এজলাসে পর্যবেক্ষণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এমনকি তাঁর খাসকামরাতেও এই শিশুদের আলাদাভাবে খোঁজখবর নেন, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। গত বুধবার এই বাচ্চাদের নিয়ে সব দম্পতি আদালতে এসেছিলেন। সেখানেই এই দম্পতি ও তাঁদের নেওয়া শিশুদের সঙ্গে দেখা হয়।

ছেলে এখন রাতে আমার গলা জড়িয়ে না ধরলে ঘুমাতে পারে না। এর মধ্যে আমার স্বামী মারা গেছেন। দেশে কেউ নেই। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। কিন্তু ছেলে আমাকে কাঁদতে দেয় না। চোখ মুছে দেয়। এখন ওর জন্য আমি বেঁচে আছি।
আদালতের মাধ্যমে সন্তান পাওয়া এক স্কুলশিক্ষক

সর্বশেষ বাচ্চাটি নিয়েছেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনে বাচ্চা হয়নি। তিনি পিএইচডি করতে গিয়ে ইংল্যান্ড ও কানাডায় চিকিৎসা নিয়েছেন। সর্বশেষ ভারতে টেস্টটিউব বেবি নেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি। তিনি আদালতের মাধ্যমে দেড় বছরের একটি মেয়েকে পেয়েছেন।

পাবনা থেকে ছেলেকে নিয়ে এক স্কুলশিক্ষক মা এসেছিলেন। তাঁর ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তান হয়নি। তাঁর ভাইবোনেরা সব দেশের বাইরে থাকেন। তাঁর জীবনটা হতাশায় ভরে উঠেছিল। দুই বছর আগে এই ছেলেটাকে নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে এখন রাতে আমার গলা জড়িয়ে না ধরলে ঘুমাতে পারে না। এর মধ্যে আমার স্বামী মারা গেছেন। দেশে কেউ নেই। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। কিন্তু ছেলে আমাকে কাঁদতে দেয় না। চোখ মুছে দেয়। এখন ওর জন্য আমি বেঁচে আছি।’

ঠাকুরগাঁও থেকে ছেলে নিয়ে এসেছিলেন এক মা। বললেন, ‘১৩ বছর নিঃসন্তান ছিলাম। ২০১৮ সালে এই ছেলেকে পেয়েছি। এখন সে আমাকে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।’ মেহেরপুর থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন এক মা। তাঁরও অনুভূতি একই রকম।

আলমগীর কবিরের বাসা রাজশাহীতে। তিনি বলেন, ‘১৩ বছর নিঃসন্তান জীবন কেটেছে। তারপরে আদালতের মাধ্যমে একটি ছেলে পেয়েছি। আদালতের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সব আদালতে যেন এই মহৎ উদ্যোগ নেন।’

বিচারক আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তান লাভে বিলম্ব হয়েছিল। সন্তানের জন্য নিঃসন্তান দম্পতির আকুতিটা তিনি সহজেই উপলব্ধি করেন। যদিও পরে তাঁর স্বাভাবিকভাবে তাঁর সন্তান হয়। তাঁর মেয়ের বয়স এখন ছয় বছর। তার নাম মানহা। সন্তানের প্রতি মমত্ববোধের জায়গা থেকে তিনি নিজের মেয়ের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ১২ জন ছেলেমেয়ের একটি করে ডাকনাম রেখে দিয়েছেন। নামগুলো মানছুরা, মানজুরা, মাশরুরা, মিরালনা, মুনতাহা, মাহিন, মাশরাফি, মুবিন, মারভিন, মাহদি, মাহির ও মারজিনা।

বিচারক বলেন, সন্তান নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে, এমন দম্পতি ছোটমণি নিবাস থেকে একটি বাচ্চা নেওয়ার জন্য এই আদালতে আবেদন করেন। আদালত দম্পতির সন্তানের আকাঙ্ক্ষার সত্যতা, সন্তান প্রতিপালনের আর্থিক যোগ্যতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন। আইনজীবী আসুরা খাতুন ও রত্নালেখা নাসরিনের মাধ্যমে এই আবেদনগুলো করেছেন।

রাজশাহী ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক মনিরুজ্জামান বলেন, আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জহাট সেতুর ওপরে একটি শপিং ব্যাগে ভেজা কাপড়ের পোঁটলায় একটি এবং নীলফামারীর পাটগ্রামে ভুট্টাখেতে লুঙ্গি ও ওড়নায় জড়ানো অবস্থায় অপর একটি নবজাতক পাওয়া গিয়েছিল। এমন ধরনের শিশুরাই ছোটমণি নিবাস থেকে এই সব নিঃসন্তান দম্পতির কাছে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে অনেক উচ্চ শিক্ষিত এবং সচ্ছল নিঃসন্তান দম্পতি রয়েছে, যাঁদের পারিবারিক জীবনে একটি সন্তানের বড় অভাব। আর একটি অসহায় শিশুর রয়েছে মা–বাবার অভাব। এই পরিপূরক অনুভূতিকে অনুধাবন ও সমন্বয় সাধন করেছেন রাজশাহী সদর আদালতের বিচারক সাঈদ আহমেদ স্যার। পরস্পরকে দিয়েছেন পূর্ণতা, প্রশান্তি এবং শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। এই উদ্যোগ অনুকরণীয়।’