বিদ্যালয় নয়, শিশুদের কাছে যেন আনন্দ ভুবন

চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের বকুয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায়।

ভবন সাজানো হয়েছে শিশুদের শিক্ষার উপযোগী করে। নানা রঙে আঁকা বাংলা-ইংরেজি বর্ণমালা, গণিতের চিহ্ন, ফুল। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েছবি: প্রথম আলো

মাঠে সাজানো সারি সারি খেলার উপকরণ। রংবেরঙের ফুলগাছের মাঝে এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে আছে হাতি, ঘোড়া, হরিণ, জিরাফসহ কত প্রাণী। আছে বক, টিয়া, ময়ূরও। দূর থেকে বিনোদনকেন্দ্রের মতো মনে হলেও আসলে এটি একটি বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয়জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এমনই মুগ্ধকর পরিবেশ। যা শিশুদের আনন্দের ভুবন হয়ে উঠেছে।

বিদ্যালয়টির নাম চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। ২০০০ সালে ইউনিয়নের বহরমপুর বাজারে এরফান আলী চা-নাশতার দোকান চালাতেন। পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। দিনে দু-তিনবার চা নিয়ে এরফানকে ওই বিদ্যালয়ে যেতে হতো। এইচএসসি পাস এরফানও স্বপ্ন দেখতে লাগলেন শিক্ষকতা করার। ২০০১ সালে ছেলের প্রস্তাব পেয়ে গ্রামে একটি স্কুল খোলার জন্য ৩৩ শতাংশ জমি দেন বাবা নুরুল ইসলাম। জঙ্গলাকীর্ণ ধানখেতের জমি পরিষ্কার করে খড়-বাঁশের তিনটি ঘর তৈরি করলেন। ২০০৮ সালে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন এরফান। ২০১১ সালে বিদ্যালয়টি পাঠদানের অনুমতি পায়। শিক্ষার্থীর সন্ধানে রাতদিন অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান শিক্ষকেরা। সফলতাও আসে। বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে সরকারি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

২০১৩ সালেও চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫০ শিক্ষার্থী ছিল, কিন্তু প্রতিদিন হাজির থাকত ৫০ থেকে ৬০ জন। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধের উপায় খুঁজতে থাকেন এরফান আলী। সভা ডাকলেন। বিদ্যালয়ে এসে কোনো শিক্ষার্থীকে যাতে ক্ষুধার্ত থাকতে না হয়, সে জন্য ‘মিড ডে মিল’ চালুর পরিকল্পনার কথা জানালেন। কাজে নেমে পড়লেন এরফান আলী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে তাঁর উদ্যোগের কথা জানালেন। অভিভাবকেরা মুষ্টি চাল দিয়ে উদ্যোগের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন। মিড ডে মিল চালু হলো। প্রতি মাসে এর জন্য ৩০-৩৩ হাজার টাকা লাগে। এ অবস্থায় স্থায়ী আয়ের কথা ভাবলেন এরফান। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম নিজের ছয় বিঘার একটি পুকুর ও এক বিঘা জমি সাময়িকভাবে বিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দিলেন। বকুয়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু তাহের, ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি মো. কলিমউদ্দিনসহ গ্রামের আরও অনেকে মিড ডে মিল কর্মসূচি টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে এলেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মিলে পুকুরে হাঁস পালন আর দুই বিঘা জমিতে পেঁপে ও সবজি আবাদ শুরু করলেন। যে টাকা আসত, তাতে চলে যেত মিড ডে মিলের তহবিলে। মিড ডে মিল চালুর পর থেকে শিক্ষার্থীর গড় উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ শতাংশে। ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সবাই মিলে মিড ডে মিল’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেন। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের আশ্বাস দেন।

২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বয় সভায় এই স্কুলের মিড ডে মিলের মডেলটি আলোচনায় আসে। এরপর অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের এই ধারণাকে অনুসরণ করতে বলা হয়।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিতালী পারভিন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম। আর প্রথম আলো আমাদের চেষ্টা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। এর পর থেকেই বিদ্যালয়ের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে এখন বিভিন্ন খেলনার পাশাপাশি বিনোদন পার্ক স্থাপন করা হয়।