বিদ্যুৎহীন পরিবারটির সবার প্রাণ গেল বিদ্যুতের আগুনে

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিদ্যুৎ থেকে লাগা আগুনে একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। পোড়া জিনিস সেই দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেদিনার মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচল ১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মাসুম মিয়া। তিনি ইজিবাইকচালক। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে খেয়ে না–খেয়ে দিন কাটে তাঁর। অন্যের জমিতে ঘর বেঁধে পেতেছিলেন দুঃখ–সুখের সংসার। মাসুমের সেই ঘরের ওপর দিয়েই চলে গেছে পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। মাসুমের সামর্থ্য ছিল না ঘরে বিদ্যুৎ–সংযোগ নেওয়ার। অথচ সেই বিদ্যুতের আগুনেই পরিবারসহ পুড়ে মরলেন তিনি।

গতকাল শুক্রবার রাতে ডেসকো ও পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন সংযোগে লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন মাসুম মিয়া (৪০), তাঁর স্ত্রী সীমা আক্তার(৩৩) ও দুই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলে আবদুল্লাহ (১৭) ও রহমতুল্লাহ (১০)। ঘরের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচেছেন মাসুমের একমাত্র মেয়ে মাহফুজা আক্তার (২০)।

আবদুল্লাহ ও রহমতুল্লাহর জীবন কেটেছে শেকলে বাঁধা অবস্থায়। সন্তানদের ভালো–মন্দ বোঝার জ্ঞান নেই। তাদের চোখে চোখে রাখতে দুই সন্তানকে ঘরের ভেতর শেকলবন্দী করে রাখতেন মাসুম–সীমা দম্পতি। গতকালও তারা শেকলবন্দী ছিল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেকলবন্দী অবস্থায় আগুনে পুড়ে মরেছে আবদুল্লাহ। রহমতুল্লাহও সুযোগ পায়নি ঘর থেকে বের হওয়ার। আর সন্তানদের বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে মরেছেন মাসুম ও সীমা।

স্বামীর সঙ্গে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় থাকেন মাসুম-সীমা দম্পতির মেয়ে মাহফুজা। গতকাল এসেছিলেন বাবার বাড়িতে। আগুন লাগার পরপরই দৌড়ে ঘর থেকে বের হন তিনি। তারপর আর ঘরে ফেরা হয়নি। চোখের সামনে পুড়ে মরতে দেখেছেন বাবা, মা আর ভাইদের। তারপর থেকেই তিনি নির্বাক। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পোড়া ঘরের দিকে, কয়েক ঘণ্টা আগেও যে ঘর প্রাণবন্ত ছিল মাহফুজার প্রিয়জনদের হাসি–উল্লাসে।

আজ শনিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মাসুমের টিনশেড ছোট্ট ঘরটির পুরোটাই পুড়ে গেছে। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে আসবাবপত্রের পোড়া অংশ। ঘরের এক পাশে পড়ে আছে পোড়া ইজিবাইক, পাশেই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে পোড়া চাল, খাবারের হাঁড়ি ও জামাকাপড়।

মোক্তার হোসেন নামে মাসুমের এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের আগে এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎ ছিল না। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে আসেন তিনি। এসেই দেখেন মাসুমের ঘরের ওপর একটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ছিঁড়ে পড়ে আছে। আগুনে পুড়েছে মাসুমের পুরো পরিবার। বিদ্যুতের আগুন বলে ভয়ে কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। চোখের সামনে চারটি প্রাণের মৃত্যু কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে তাঁদের।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় মাসুমের মামা নূর হোসেন বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। মাসুমের ঘরের ওপর দিয়ে যাওয়া পল্লী বিদ্যুতের ১১ হাজার ভোল্টের খোলা তারে ডেসকোর ৩৩ হাজার ভোল্টের সঞ্চালন লাইন ছিঁড়ে পড়ে। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসিনুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকালে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ চারটি নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পর থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।