বিনা চিকিৎসায় মরে মা ও শিশুরা

মদনপুর ইউনিয়নের মিজি বাড়ির দরজার কমিউনিটি ক্লিনিক। এর সামনে রয়েছে মস্ত খাল
ছবি: প্রথম আলো

সন্তান প্রসবের সময় জোসনা বেগমের (৩৪) যখন প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। গ্রাম্য ধাত্রী নুরুন্নাহার রোগ ধরতে পারেননি। বুঝতে পারেননি কী করতে হবে। তিনি ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু নদীপথে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই মারা যান জোসনা। মারা যাওয়ার আগে জন্ম দেন এক কন্যাশিশু। বাবা দিনমজুর নাজিম উদ্দিন (৪২) কীভাবে এ সন্তানকে মানুষ করবেন, সে উপায় করতে না পেরে নবজাতককে অন্যের হাতে দত্তক দেন। শিশুটির বয়স এখন প্রায় ৬ মাস।

নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। দুঃখ, ডাক্তরের চিকিৎসা না পাইয়া মোইররা গেছে অর মায় (জোসনা)। চরে একজন পাস করা ডাক্তর থাকলে এই দুঃখ থাইকতো না।’

মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা দুর্গম চর ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চিকিৎসাসেবার চিত্র এটি। এ ইউনিয়নের দক্ষিণে নেয়ামতপুর (মেদুয়া ইউনিয়নের অংশ), উত্তরে বারাইপুর-রামদেবপুর (কাচিয়া ইউনিয়নের অংশ), মাঝখানে মদনপুরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চরপদ্মা গ্রামে দিনমজুর নাজিম উদ্দিনের (৫১) বাড়ি।

শুধু জোসনা বেগমই নন, মদনপুর ও এর আশপাশের চরাঞ্চলে প্রতিবছর এভাবে অনেক প্রসূতি ও শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ইউনিয়নের সাবেক গ্রাম পুলিশ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধু ৪ নম্বর ওয়ার্ডেই গত বছর তিন শিশু, কিশোরী ও প্রসূতি মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। এদের মারা যাওয়ার ঘটনা সরকারের খাতায় লিপিবদ্ধ হয় না।

মদনপুর ইউনিয়নে ১০-১২ হাজার মানুষের বাস। দুই পাশের কাচিয়া ও মেদুয়া চরে রয়েছে আরও ৮-১০ হাজার বাসিন্দা। সব মিলিয়ে ২০ হাজার মানুষের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই এই চরে। ভোলা শহরে চিকিৎসা নিতে উত্তাল মেঘনা পার হতে হয়। প্রস্তুতি নিতে এবং হাসপাতালে পৌঁছাতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় দরকার। সরকারি হিসাবে প্রতি মাসে ২২-২৫ জন প্রসূতি মা বাড়িতেই সন্তান প্রসব করছেন। অবস্থার অবনতি হলে ছুটে যান চরের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। স্থানীয় লোকজন জানান, চরে প্রায় ১৫ জন পল্লিচিকিৎসক আছেন, যাঁরা মানুষ ও গবাদিপশুর সব ধরনের চিকিৎসা দেন।

মদনপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক দৌলত বলেন, চিকিৎসা পাওয়া সব মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু মদনপুরে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, চিকিৎসকও নেই। আছে দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক। তা-ও প্রায়ই বন্ধ থাকে। এর একটি পাটওয়ারী বাড়ির দরজার কমিউনিটি ক্লিনিক, যেখানে ২০১৯ সালের শেষ দিকে টেলিমেডিসিন সেবার উদ্বোধন করা হয়। সেখানে কম্পিউটার, যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। এখানে বসে ঢাকার চিকিৎসক চরের রোগীদের চিকিৎসা দেবেন বলা হয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটার-যন্ত্রপাতি চালানোর লোকবল নিয়োগ হয়নি।

১৭ জানুয়ারি সরেজমিনে লুৎফর রহমান পাটোয়ারী বাড়ির দরজার ক্লিনিকে মূল ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। ক্লিনিকটির পিলার উঁচু। লম্বা র‌্যাম্পজাতীয় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। এ সিঁড়ি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ভেঙে গেছে। এখন রোগী ও সিএইচসিপি বাদুড়ঝোলা হয়ে ক্লিনিকে প্রবেশ করছেন। ঝুল, কালি, ময়লা-আবর্জনা। দেখে মনে হয় এটা খোলা হয় না অনেক দিন।

এলাকাবাসী জানান, ছয় মাস যাবৎ এমন অবস্থা চলছে। দেখার কেউ নেই। ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সপ্তাহে এক দিন আসেন, কোনো সপ্তাহে আসেন না। যেমন বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) আসেননি।

ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের টবগী গ্রামে মিজি বাড়ির দরজার কমিউনিটি ক্লিনিক। এ ওয়ার্ডের চারপাশে বড় খাল। মানুষকে এই ওয়ার্ডে কিংবা ক্লিনিকে প্রবেশ করতে হলে সাঁতরে নইলে নৌকায় পার হতে হয়। একটি সাঁকোও নেই। এ ক্লিনিকে যেতে সিএইচসিপির সৌরভেরও কষ্টের শেষ নেই। তিনি বলেন, বরিশালে ট্রেনিং থাকার কারণে গত সপ্তাহে চরে যেতে পারেননি। জোয়ারভাটা মেপে, কাদাপানির মধ্যে লড়াই-যুদ্ধ করে ক্লিনিকে যেতে হয়। প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী হয়। গুরুতর রোগীদের ভোলায় যেতে বলেন। কারণ, চরে কোনো চিকিৎসক নেই।

ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল খালেক বলেন, সরকার চরে সাবমেরিন কেব্‌ল দিয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিচ্ছে। কিন্তু চরের মানুষ চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সে ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেই।

ভোলার সিভিল সার্জন সৈয়দ রেজাউল ইসলাম বলেন, যে ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, সেখানে চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমও) বরাদ্দ হয় না। মদনপুরের মতো দুর্গম চরে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবু তিনি ক্লিনিকগুলো ঠিকমতো চলছে কি না, তা তদারক করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।