বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট

দুই উপজেলার অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে।

একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে দূরের এলাকা থেকে ট্রলারে খাওয়ার পানি আনা হচ্ছে। সেই পানি নিতে ভিড় করেছে এলাকার লোকজন। গত রোববার শ্যামনগর উপজেলার দুর্গাবাটি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

‘আমাগো পানির খুব কষ্ট। বৃষ্টির পানি ফুরিয়েছে আরও তিন মাস আগে। এলাকায় কোনো ফিল্টার নেই। পুকুর পর্যন্ত শুকিয়ে গে। বাধ্য হয়ে দুই করোশ (প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার) হেঁটে শ্যামনগর যেয়ে পানি আনতি হতেছে।’ কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুকদাসী মণ্ডল। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাঁচড়াহাটি গ্রামে।

সুকদাসী মণ্ডলের পাশে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রতিবেশী চন্দনা রানী। তিনি বলেন, ‘ভাত না খেয়ে দু-চার বেলা কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে জল ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচা যায় না। ঘরের কাজ ফেলায় রেখে দিদিগো সঙ্গে জল আনতি যাতেছি। প্রতিদিন দুবার জল টানতি গে দিনের অর্ধেকটা সময় চলে যাচ্ছে।’

সুপেয় পানির এই সংকট পুরো শ্যামনগর উপজেলায়। এ ছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টিতে পানির সংকট রয়েছে। সব মিলিয়ে দুই উপজেলার অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভোগান্তিতে রয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় এবং তীব্র গরমে বর্তমানে সংকট তীব্র হয়েছে। এলাকার বিত্তবান পরিবারগুলো দূরদূরান্ত থেকে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানি কিনে আনছে। উপকূলীয় এই জনপদের সিংহভাগ মানুষকে খাওয়ার পানির জন্য প্রতিদিন লড়তে হচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সরবরাহ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তবে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবের পর এ সমস্যা দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে বছরের ছয় মাস চাহিদা পূরণ হয়। বৃষ্টির কম হওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সংকট প্রকট হয়েছে। ইতিমধ্যে খরতাপের প্রভাবে মিঠাপানির পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে। গভীর-অগভীর নলকূপের পাশাপাশি পানির অভাবে অধিকাংশ পিএসএফ (পুকুরের পানির সরবরাহব্যবস্থা) অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী উপপ্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শ্যামনগরে খাওয়ার পানির প্রকট সংকট রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর সংকট তীব্রতর হয়েছে। সরকারি পুকুর পুনরায় খননকাজ শেষ হলে পানি সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।

আইলার তাণ্ডবের পর গত কয়েক বছরে ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে লবণপানি ঢুকেছে। এতে পুকুর ও জলাশয়ের পানি লবণাক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বোরো ধান, তরমুজ ও সবজি চাষে সেচ দিতে বেশির ভাগ পুকুর পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ও মথুরেশপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টি না হওয়ায় পানির অধিকাংশ উৎস শুকিয়ে গেছে। কালীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুকুরের পানি একেবারে নিচে নেমে এসেছে। পুকুরের পিএসএফ ফিল্টার অকেজো অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় লোকজন পুকুর থেকে পানি নিয়ে সরাসরি ব্যবহার করছেন। কেউবা পানিতে ফিটকিরি দিয়ে পান করছেন।

উপজেলার হাড়দাহ গ্রামের হালিমা বেগম বলেন, ‘পানি মেপে মেপে খাই। এই গরমে পানি মেপে খেলে কি শরীর থাকে?’

এলাকায় পানি নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রেরণা। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী বলেন, পুকুরগুলো শুকিয়ে পিএসএফ সব নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টির দেখা না পাওয়া যাওয়ায় পানি স্তর নেমে গেছে। গভীর ও অগভীর নলকূপগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। এসব কারণে কালীগঞ্জ উপজেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলে পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

জানতে চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অমল কুমার রায় বলেন, কালীগঞ্জে পানির স্তর ৩৫-৩৮ ফুট নেমে গেছে। এ জন্য নলকূপে পানি উঠেছে না। উপজেলার ১২ ইউনিয়নের মধ্যে ধলবাড়িয়া, রতনপুর, কৃষ্ণনগর ও চাম্পাফুল ছাড়া কোথায় গভীর নলকূপ সফল হয় না। সাত মাসের ওপর বৃষ্টি না হওয়ায় উপজেলার পুকুরগুলো সব শুকিয়ে গেছে।