বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ছাত্রের মৃত্যু

রূপপুরে সেই ‘বালিশ-কাণ্ড’র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ করছে। তাদের মালামাল পরিবহনের সময় ট্রাকচাপায় ছাত্রের মৃত্যু হয়।

মাহমুদ হাবিব

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও অবহেলায় ট্রাকচাপায় ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণসামগ্রী বহনকারী এসব ট্রাক দিনরাত যখন-তখন চলাচল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে রাতে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সে জায়গা অন্ধকার ছিল। খুঁটির বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল না। অন্ধকারে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান মাহমুদ হাবিব।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে একটি ২০ তলা ও দুটি ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ করছে। এ জন্য বিপুল পরিমাণ মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে, যার লিখিত কোনো নীতিমালা নেই। ট্রাকগুলো সারা দিন ও রাতভর মাল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে, বের হয়। নির্মাণকাজেরও কোনো সময়সীমা নেই। শিক্ষার্থীরা মৃত্যুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাঈদ আহমেদ গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে হলের সামনের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখেন, শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিবের লাশ পড়ে আছে। তিনি তাঁর মুঠোফোনে একটি ছবি তোলেন। গতকাল বুধবার দুপুরে তিনি ছবিটি এই প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, আলো না থাকায় তাঁকে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবিটি তুলতে হয়েছে। তাঁর মতে, আলোর স্বল্পতার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

যেখানে মাহমুদ হাবিবের লাশ পড়েছিল, সেখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে ঠিকই। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় সেখানে কোনো আলো ছিল না। পাশে একটি সার্চলাইট ছিল। কিন্তু দুদিন আগে থেকে সেটিও অচল হয়ে ছিল।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে ট্রাকচাপায় মারা যান মোটরসাইকেল আরোহী শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব ওরফে হিমেল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিকস ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বাড়ি বগুড়ায়। তবে অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকতেন নাটোরে। দুর্ঘটনায় আহত চারুকলার মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান প্রামাণিক ওরফে রিমেল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি শঙ্কামুক্ত হলেও তাঁর একটি পা গুরুতর জখম হয়েছে।

শহীদ হবিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. ফারদিন এহসান ও সাকিব শওকত বলেন, তিনি ঘটনার ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর এসে দেখেন, অন্ধকারে লাশ পড়ে আছে। দুর্ঘটনার খবর জানাজানি হওয়ার পর রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূল ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গাড়ি চলাচলে কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের উদাসীনতার কারণেই এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গাড়ি চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা কোন এলাকায় কত হবে, তা নির্ধারণ করে ফলক দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। ভেতরের ফুটপাত প্রশস্ত ও সড়কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা উচিত। কমপক্ষে রাত ১২টার আগে নির্মাণসামগ্রীর ট্রাক ঢোকানো উচিত নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ ও মালামাল পরিবহনের ব্যাপারে কোনো নীতিমালা থাকা উচিত কি না, জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, আবাসিক এলাকায় নির্মাণযন্ত্র ব্যবহারের শব্দ ও মালামাল পরিবহনের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আবাসিক এলাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একাডেমিক কাজের বাইরে যেকোনো কাজ করতে গেলেই কর্তৃপক্ষের একটি নীতিমালা ঠিক করে দেওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভারী যানবাহন চলাচলের জায়গা নয়। কিন্তু নির্মাণকাজ করা অপরিহার্য। এ কারণেই তাঁদের মালামাল পরিবহন করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে লিখিত কোনো নীতিমালা আছে বলে তাঁর জানা নেই। হয়তো সিটি করপোরেশনের ভেতরে যেটা প্রযোজ্য, সেটা এখানেও হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান বলেন, গত জুলাইয়ের দিকে তাঁরা লক্ষ করেন, মালামাল নিয়ে গাড়িগুলো বিভিন্ন ফটক দিয়ে ঢুকছে। তখন তাঁরা শুধু চারুকলা অনুষদের সড়কটি মালামাল পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বধ্যভূমির দিকের সড়কটি মালামাল পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন, শহীদ হবিবুর রহমান হলের কাছে তাঁদের একটা সার্চলাইট ছিল। দুদিন আগে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটনার পর গতকাল সেটি ঠিক করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে খুঁটির বৈদ্যুতিক বাতি নিভে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব খুঁটিতে বাতি আছে, কোনো একটা কেটে যেতেই পারে।

গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাকবলিত স্থানটিতে গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার রাস্তার পাশের সব খুঁটির বাতি দিনেও জ্বলছে। শুধু ওই খুঁটির বাতিই জ্বলতে দেখা যায়নি।

রূপপুরের সেই ‘বালিশ কাণ্ড’র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ তলা বিজ্ঞান ভবন নির্মাণের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আসিফ হোসেনকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দুদক গ্রেপ্তার করেছিল। দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি শুনেছেন। তিনি ঢাকায় আছেন। তাঁরা পাথর পরিবহনের জন্য স্থানীয় একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই লোক গাড়ি ভাড়া করে পাথর দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের করার কী আছে!