বিষখালীতে ইলিশের ভান্ডার

বিষখালী নদীতে পাওয়া ইলিশ হাতে এক জেলে। সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটার বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এলাকায়ছবি: আমিন সোহেল

ইলিশের খ্যাতি তার অসাধারণ স্বাদ ও গন্ধের কারণে। এর মধ্যে আবার পদ্মার ইলিশের প্রসিদ্ধিই প্রধান। নদীর পানি থেকে তোলার পর বাঙালির রান্নাঘর হয়ে খাবারের থালায় গিয়েই তার যাত্রাপর্ব শেষ হয়নি, ঠাঁই পেয়েছে শিল্প–সাহিত্যেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসই রচনা করেছেন পদ্মার ইলিশ আর মাঝিদের নিয়ে। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে ইলিশ ধরার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি— ‘নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে। নিষ্পলক চোখগুলো স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’

পদ্মার ইলিশের স্বাদ যতটা, তার প্রচারও তেমনি অনেক। কিন্তু সে তুলনায় বরিশালের বিষখালী নদীর ইলিশের ততটা প্রচার নেই। স্বাদের বিচারে বিষখালীর ইলিশ কিন্তু পদ্মার ইলিশের চেয়ে কম নয়। বরং স্বাদ ও গন্ধে এর আলাদা বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। বরিশালের মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, বিষখালী নদীর ইলিশের স্বাদ–গন্ধ নিয়ে এই অঞ্চলে সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলের ইলিশের জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নিলে এই এলাকার ইলিশের কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেতে পারে।

বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। স্থানীয় মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুসারে বরিশাল বিভাগ এখন দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬৬ ভাগ জোগানদাতা। গত ২০১৮–১৯ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল অঞ্চল থেকে আহরণ করা হয় ৩ লাখ ৩২ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ভোলা ও বরগুনা ইলিশের প্রধান উৎস। এই দুই এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, বিষখালী নদীতেই দক্ষিণের সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশের বাস।

ঝালকাঠির সুগন্ধা থেকে উৎপত্তি হওয়া বিষখালীর দৈর্ঘ্য ১০৫ কিলোমিটার। সর্পিল এ নদীর অধিকাংশই বরগুনা জেলায় প্রবাহিত। এটি পাথরঘাটায় গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বিষখালী যেখানে সাগরে মিশেছে, সেখানে আরও দুই নদ-নদী বলেশ্বর এবং পায়রাও এসে সাগরে পড়েছে। তিনটির মধ্যে কেবল বিষখালীতে অল্প উজানে এলেই মিষ্টি পানি। দিনে ও রাতে দুই বেলা জোয়ারের প্রবাহ বেশি বলে এই নদীর পানিও স্বচ্ছ। কিন্তু পায়রা ও বলেশ্বরের মিঠাপানি আরও অনেক বেশি উজানে। তা ছাড়া যে নদীর পানি যত স্বচ্ছ, সে নদীর ইলিশের পিঠের দিকও তত কালচে ও পুরু। নদীর পানি ঘোলা হলে ইলিশের পিঠের কালচে রং গাঢ় হয় না। যেসব ইলিশের পিঠের রং কালচে, সেগুলোর স্বাদও বেশি। এ জন্যই বিষখালীর ইলিশ পরিপুষ্ট, উজ্জ্বল ও বেশি স্বাদযুক্ত বলে মনে করা হয়।

চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, প্রজননকালে ইলিশ সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে আসে। সাগরে থাকাকালে এরা প্রচুর সাঁতার কাটে। খাবারও কম খায়। তাই শরীরে চর্বি বিশেষ থাকে না। নদীতে প্রচুর শৈবালজাতীয় উদ্ভিদ থাকে। এসব খাবার ইলিশকে পরিপুষ্ট করে তোলে, আর শরীরে অনেক চর্বিও জমে। এ কারণেই স্বাদ ও গন্ধে ইলিশ অনন্য হয়ে ওঠে।

ইলিশ গবেষক ও মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব বলেন, বিষখালীর ইলিশের সুখ্যাতি আছে। ইলিশের দুটি ভান্ডার বঙ্গোপসাগর ও পদ্মা-মেঘনার ইলিশ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। বিষখালীর ইলিশ নিয়ে গবেষণা হলে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যের ইলিশের ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।