বীরত্ব গর্বিত করে, দারিদ্র্য অনেক কষ্ট দেয়

একটি স্থায়ী বসতঘর পাওয়ার আশায় যোগমায়া মালো ছুটে গিয়েছেনও বিভিন্ন স্থানে। প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন, কিন্তু ঘর মেলেনি
ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা যোগমায়া মালো (৭০)। ১৯৭১ সালে কিশোরী বধূ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াল স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়া করে ফেরে। বয়সের ভারে যোগমায়া মালো এখন অন্যের জমিতে টিনশেডের ঘরে শয্যাশায়ী।

স্থায়ী আশ্রয় না থাকায় গ্রামের এক স্কুলশিক্ষকের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টিনের ঘরে বসবাস করছেন। একটি স্থায়ী বসতঘর পাওয়ার আশায় ছুটে গিয়েছেনও বিভিন্ন স্থানে। প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন, কিন্তু ঘর মেলেনি।  

দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের নেপাল মালোর স্ত্রী যোগমায়া মালো। ১৯৭১ সালের ২২ মে মধ্যপাড়া গ্রামে গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। সেদিন যোগমায়া মালোর স্বজনদের হত্যা করে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানিদের মাদারীপুরের ক্যাম্পে। আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। স্বাধীনতার দুই বছর পর স্বামী নেপাল মালো মারা যান। এরপর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে শুরু করেন কষ্টের জীবন।

দারিদ্র্য আর কষ্ট যোগমায়া মালোর পিছু ছাড়েনি। স্বাধীনতার পর নানান চাপে শ্বশুর আর স্বামীর ভিটেমাটি হারাতে হয়েছে। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক শ্যামল রায়ের বাড়িতে ৪০ বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন। দুই ছেলে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম ওঠে যোগমায়া মালোর। সরকার এখন ভাতা দেয়। ভাতার টাকায় চিকিৎসাব্যয় চলে।

আজ বুধবার দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি টিনের ঘরের মধ্যে শুয়ে আছেন যোগমায়া মালো। এক ছেলে, পুত্রবধূ ও তিন নাতি-নাতনিও এই ঘরে থাকেন। অভাবের সংসারে যোগমায়ার নাতি-নাতনিরা স্থানীয় বাজারে শ্রমিকের কাজ করেন।

এক ছেলে, পুত্রবধূ ও তিন নাতি-নাতনিও টিনশেডের ঘরে থাকেন যোগমায়া মালো
ছবি: প্রথম আলো

চোখের জল মুছতে মুছতে যোগমায়া মালো বলেন, ২২ মে তাঁদের গ্রামসহ আশপাশের হিন্দুপাড়াগুলোতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালায়। স্বামী পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে সাহস পাননি। বসতঘরেই ছিলেন। ২৩ মে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ঘর থেকে তাঁকে টেনে বের করে। উঠানে অন্তত ১০০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে তাঁকেও বসানো হয়। নারীদের উঠানে রেখে পুরুষদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর ৩০-৩৫ জন নারীকে নেওয়া হয় মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে চার দিন আটকে রেখে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ওপর নির্যাতন চালান। যোগমায়া মালো বলেন, পাঁচ দিনের মাথায় তাঁরা ছাড়া পান। ফিরে দেখেন, বাড়িঘর নেই, ছাই পড়ে আছে। পরে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন।

সেদিনের ঘটনার সাত দিন পর স্বামীকে খুঁজে পান যোগমায়া। পরে বাড়ির পাশের একটি বাগান থেকে ভাশুর হিরা লাল মালোর অর্ধগলিত লাশ পাওয়া যায়। স্বাধীনতার দুই বছর পর মারা যান যোগমায়ার স্বামী। এর পর থেকে অন্যের বাড়িতে থাকেন।

যোগমায়ার পুত্রবধূ ডলি রানী মালো বলেন, শাশুড়ির বীরত্ব তাঁদের গর্বিত করে। আবার দারিদ্র্য অনেক কষ্ট দেয়। তিন বছর ধরে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু থাকার স্থায়ী কোনো জায়গা নেই। একটি ঘর পেলে কষ্ট কিছুটা দূর হতো।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান বলেন, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। প্রথম পর্যায়ে শরীয়তপুরে ৭২টি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের তালিকায় যোগমায়া মালোর নাম আছে।