বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নষ্ট হচ্ছে ১০ হাজার টন কাঁচা মাছ

বৃষ্টির পানিতে দুবলার চরে শুকাতে দেওয়া কাঁচা মাছ পচতে শুরু করেছে। আলোর কোল, দুবলার চর, ৬ ডিসেম্বর দুপুর
ছবি: প্রথম আলো

‘দুবলার এই জাইলে পাড়ায় বছরে পাঁচ মাসের জন্নি আমরা আসি। সাগর দিয়ে মাছ ধরি, রোদে শুকুয়ে শুঁটকি করি। শুঁটকির পুরো সিজিনি আমরা গোন (সাগর থেকে মাছ আহরণের সময়) পাই ১০টার মতো। এই গনে জাইলেরা ভালো মাছ পাইল। সবাই কাঁচা মাছ শুঁটকির জন্নি রোদে দিল। কিন্তু বর্ষায় তো সব শ্যাষ! টনকে টন কাঁচা মাছ এহন পচতি বসিছে।’

নিম্নচাপের প্রভাবে তিন দিন ধরে উপকূলে চলা বৃষ্টিতে ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার চাকলা গ্রামে আবদুল গফুর গাজী (৫৯)।

সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোর কোল শুঁটকিপল্লির আরেক জেলে সাতক্ষীরার বোয়ালিয়া এলাকার মহিতোষ বিশ্বাস। এই চরে তাঁর ঘর-চাতাল সবই ডুবে গেছে রোববার রাতে সাগরের জোয়ারে। চাতালের কিছু কাঁচা মাছ ভেসেও গেছে। শুকিয়ে আগেই শুঁটকি করা মাছগুলো ঘরে মধ্যে মাচার ওপরে রাখলেও, কাঁচা মাছগুলো বাঁচাতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, ‘বাবা, খুব খারাপ অবস্থা। শ্বাসকষ্ট বাইড়ে গেছে। তা প্রায় দুই লাখ টাকার মাছ নষ্ট হইছে। সব কাঁচা মাছ চাতালে নষ্ট হচ্ছে। বর্ষায় কাঠকুটো-চুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। সব ভিজে গলাজল।’

শুঁটকির মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) দুবলার চরের প্রতিবছর উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০-২৫ হাজার জেলে-মহাজন আসেন সাগর থেকে ধরা মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করতে। শুঁটকির জন্য সুন্দরবনের এই দুর্গম চরে তাঁরা গড়ে তোলেন পাঁচ মাসের অস্থায়ী বসতি। অসময়ে বৈরী আবহাওয়ায় এখানকার হাজার হাজার জেলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

ওই চরের জেলেরা বলছেন, শুকিয়ে শুঁটকি করতে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা মাছ চরে দেওয়া হয়েছিল। বৃষ্টিতে যা নষ্ট হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ দুর্বল হলেও নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের সময় সাগরের পানির উচ্চতাও বেড়েছে।

দুবলার চরের শুঁটকিপল্লির মহাজন খুলনার পাইকগাছার দেব রায় সোমবার সকালে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, শুঁটকির জন্য সাগর থেকে ধরে আনা ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা মাছ এখন চরে পচে নষ্ট হচ্ছে। এখনো এখানে বৃষ্টি হচ্ছে। আগের দিন থেকে জোয়ারের পানি ওঠা শুরু হয়েছে। জোয়ারের সময় চরের সবকিছু ডুবে যাচ্ছে।

বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা এলাকার জেলে বেলায়েত সরদার বলেন, ‘সিডর-আইলায়ও এই চরে এত পানি ওঠেনি। আগের কটা ঘূর্ণিঝড়েও চরের অনেক ক্ষতি হয়েছে। চর ভাঙছে, বালু ধুয়ে চর নিচু হয়ে গেছে। শনিবার রাতের জোয়ারে প্রায় সব ঘর পানিতে ডুবে গেছে। কয়েকটা ঘর ভেসেও গেছে। সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুফানে জাল-চুলা, মাছ সব নষ্ট হচ্ছে। সাগর থেকে বড় বড় ঢেউ আসছে, বাতাসও হচ্ছে। এখানে খাওয়ার পানির পাতকুয়াগুলোতে জোয়ারের সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকে পড়েছে। দুর্যোগের কারণে আমরা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছি।’

পাইকগাছার মাহামুদকাঠির জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন, বৃষ্টি আর জোয়ারে ভিজে সব মাছ এখন নষ্ট। এই চরের জেলেদের কোটি টাকার বেশি মাছের ক্ষতি হয়ে গেছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে জোয়ারে পানি বেড়েছে। অনেক স্থানে প্রায় ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। দুবলার চর শুঁটকিপল্লিতে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাটে তৃতীয় দিনের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। গত রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে জেলাজুড়ে। অসময়ের বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। বঙ্গোপসাগর ও গভীর সমুদ্রে থাকা মাছ ধরার ট্রলারগুলো উপকূলে ফিরে এসেছে।
তবে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেওয়া হলেও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন মো. শাহাদাত হোসেন।