বৃষ্টিতে শেষ লবণ উৎপাদন মৌসুম, ঘাটতিতে হতাশ কক্সবাজারের চাষিরা

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরী দ্বীপ উপকূলে মাঠে পলিথিন বিছিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে লবণ। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে চলতি মে মাসের মাঝামাঝি কক্সবাজার উপকূলে ৩০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ২১ মে সকালে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে গেছে আরও ২৫ হাজার একরের বেশি জমির লবণ উৎপাদন। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আগেই শেষ হয়ে গেল চলতি মৌসুমের (১৫ ডিসেম্বর-১৫ মে) লবণ উৎপাদন কার্যক্রম।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের তথ্যমতে, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। ১৮ মে পর্যন্ত মৌসুমের পাঁচ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৩১ মেট্রিক টন। ১৯ মে থেকে টানা কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় লবণ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের লবণের জাতীয় চাহিদা ২৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু যে পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে, তাতে চাহিদায় ঘাটতি থাকে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। ঘাটতির লবণ বিদেশ থেকে আমদানি করা হলে মাঠে উৎপাদিত লবণ বাজারদর হারাতে পারে—এই শঙ্কায় উদ্বিগ্ন উপকূলের চাষিরা।

বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে উপকূলে চাষিদের কাছে মজুত আছে এ মৌসুমে উৎপাদিত ৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ। প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজির দাম পড়ে সাড়ে ৬ থেকে ৭ টাকা। যদিও বাজারে প্যাকেটজাত লবণের খুচরা মূল্য ২৫-৪৫ টাকা। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হয় ২২০ টাকার মতো। জেলায় প্রায় ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এবার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, গরম পড়েছে অনেক, লবণের বাম্পার উৎপাদনও হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, বৃষ্টির কারণে মধ্যখানে ২০-২৫ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।

বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মৌসুমের শুরু থেকে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু গত এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কালবৈশাখীর ঝড়–বৃষ্টি, মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে ২০-২২ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণে বাম্পার উৎপাদনের পরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এখন ঘাটতির লবণ আমদানি হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত সরকারের। তিনি বলেন, উৎপাদন বন্ধ হলেও চাষিদের হাতে সাত লাখ মেট্রিক টন লবণ অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। আসন্ন বর্ষায় এ লবণের দাম আরও বাড়তে পারে।

২৩ মে দুপুরে কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী উপকূলে গিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টির পানিতে সয়লাব লবণের মাঠ। আগেই চাষিরা মাঠে বিছানো পলিথিন তুলে নিয়েছেন। পলিথিনের ওপর সমুদ্রের লোনাপানি ধরে রেখে সূর্যতাপে পানি শুকিয়ে উৎপাদিত হতো লবণ।

স্থানীয় চাষি নুরুল আমিন (৪৫) বলেন, একবার বৃষ্টি হলে টানা সাত থেকে নয় দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। গত বছর ১৫ মের আগে লবণ উৎপাদন মৌসুম শেষ হয়েছিল। এবার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, গরম পড়েছে অনেক, লবণের বাম্পার উৎপাদনও হয়েছে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, মধ্যখানে ২০-২৫ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল, এ কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এখন বিদেশ থেকে ঘাটতির লবণ আমদানি হলে প্রান্তিক চাষিদের পথে বসতে হবে।

বিসিক লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিতে ৩০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়েছিল। গতকাল সোমবার পর্যন্ত এসব মাঠে আর লবণ উৎপাদিত হয়নি। তবে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফসহ বিভিন্ন উপকূলের অবশিষ্ট ২৫ হাজার একরের বেশি মাঠে ১৮ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছিল। এরপর উৎপাদন বন্ধ থাকে। এখন লবণ উৎপাদনের জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে চিংড়ি চাষ শেষ হলে পুনরায় মাঠে শুরু হবে লবণ চাষ।

টেকনাফ উপজেলা লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. শফিক মিয়া বলেন, এপ্রিল মাসের শুরুতে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ২৮০ টাকায়। এখন সিন্ডিকেট করে মধ্যস্বত্বভোগীরা লবণের দাম আরও কমিয়ে দিয়েছেন। এখন ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে কতিপয় ব্যক্তি বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চক্রান্ত চালাচ্ছে।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কয়েক বছর ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের চক্রান্তে প্রান্তিক চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার লবণ আমদানি বন্ধ রেখেছে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে লবণ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তাতেও লবণের তেমন ঘাটতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। চাষিদের স্বার্থের বিষয় বিবেচনা করে লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী।