বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ে

চলছে ব্যাঙের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। রোববার রাতে দিনাজপুরের পৌর শহরের হীরাবাগান এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রীতি অনুযায়ী বিয়ের জন্য ছায়ামণ্ডপ, পুষ্পমাল্য, গায়েহলুদ, আশীর্বাদের ধান-দূর্বা, সাত পাক ঘোরা, সিঁদুর দান, পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ, শঙ্খের বাজ, খাওয়াদাওয়া, গীত-বাদ্য-নৃত্য প্রায় সবকিছুই ছিল। বিয়েতে আগতরা নবদম্পতিকে উপহার হিসেবে দান করেছেন নগদ অর্থও। তবে বর-কনের জায়গায় ছিল দুটি ব্যাঙ।

বৃষ্টির আশায় রোববার রাত ৯টায় এমনই বিয়ের আয়োজন ছিল দিনাজপুর পৌর শহরের রাজবাটি হীরাবাগান এলাকায় কালীমন্দির প্রাঙ্গণে। স্থানীয়ভাবে এই বিয়েকে বলা হয় ‘ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গির’ বিয়ে। বরপক্ষে সুলেখা মহন্ত আর কনেপক্ষ চন্দনা রাণী মহন্ত এই বিয়ের আয়োজন করেন।

আয়োজক দুজন বলেন, আমন ধান লাগানোর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার সে রকম বৃষ্টি হয়নি। কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড খরা। এর থেকে মুক্তি পেতে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তাঁরা এই বিয়ের আয়োজন করেন। তাঁদের বিশ্বাস, বিয়ে সম্পন্ন হলে ভগবান বৃষ্টি দান করবেন। তবে এবার করোনার কারণে বিয়ের আয়োজন সংক্ষিপ্ত করেছেন তাঁরা।

বিয়ের আসরে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক নারী-পুরুষের হইহুল্লোড়। মন্দিরের বারান্দায় মাইকে ভাসছে সাঁনাইয়ের সুর, আর চলছে রান্নার আয়োজন। সুরের তালে চলছে বৃত্তাকার নৃত্য। এরই মধ্যে মন্দির মাঠের ঠিক মাঝখানে ছায়ামণ্ডপের সামনে এসে বসলেন পুরোহিত। শুরু করলেন মন্ত্র পাঠ। বর ও কনেপক্ষ গোসল করিয়ে লাল পোশাক পরিয়ে ব্যাঙ দুটিকে নিয়ে আসে বিয়ের আসরে। একে একে প্রতিবেশীরা এসে হলুদ মাখালেন, নগদ অর্থ দান করলেন। মাথায় দেওয়া হলো সিঁদুর। তারপর উলুধ্বনির সঙ্গে সাত পাক ঘোরানো শেষ হলে বিয়ে সম্পন্ন হলো। এরপর মন্দিরের পেছনের পুকুরে বর-কনেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ব্যাঙ বর ও কনেকে আনা হয়েছে বিয়ের ছায়ামণ্ডপে। একটু পরে শুরু হবে আনুষ্ঠানিকতা। রোববার রাতে দিনাজপুরের পৌর শহরের হীরাবাগান এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

এরই মধ্যে লক্ষ্মী রাণী ভৌমিক (৮৪) গেয়ে উঠলেন, ‘ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গির বিয়া কুলা মাথায় দিয়া, ও ব্যাঙ পানি আন গিয়া। খালোত নাই পানি, বিলোত নাই পানি, আসমান ভাঙ্গি পড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি।’ কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় টিপটিপ বৃষ্টি। গান শেষে লক্ষ্মী রাণী বলেন, ‘এটা লোকাচার। ব্যাঙ বিয়ে দিলে বৃষ্টি হয়, তাই এই আয়োজন করে থাকি।’

ঠিক কবে থেকে এ ধরনের বিয়ের সংস্কৃতি চলে আসছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি কম হলে কিংবা প্রচণ্ড খরা হলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ ধরনের ব্যাঙ বিয়ের আয়োজন করে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই আয়োজন করলে বৃষ্টি নামবে এবং ধান ভালো উৎপাদন হবে।

বিয়ের আয়োজনে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন তপন কুমার গোস্বামী। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এমন আয়োজন। এটা আমাদের লোকাচার। আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যাতে করে বৃষ্টি হয় এবং করোনার এই গ্রাস থেকে সকলে মুক্ত হই।’

বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক দিনাজপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদুল হক। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির কাজ করতে গিয়ে পুথিপুস্তকে এমন আয়োজনের কথা জেনেছেন। মূলত হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করতেই ব্যাঙ বিয়ের আয়োজন। এটা কোনো ধর্মীয় ব্যাপার নয়, একটি লোকাচার। সনাতন ধর্মাবলম্বী ও আদিবাসী সমাজ এমন আয়োজন করে থাকে।

তিনি বলেন, ‘আজকে অভিভূত হলাম সারা দিন খুব গরম ছিল। যখন ব্যাঙের বিয়ে শুরু হচ্ছে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির ঝিরিঝিরি জল পড়তে দেখলাম।’