বেশি কাজ করেও কম মজুরি পাচ্ছেন নারীরা

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের দাড়ছিড়া নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে চিংড়ি মাছের মাথা ফেলে দেওয়ার কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরাছবি: প্রথম আলো

কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শোভা রানীকে (৫২) কাজে ছুটতে হয়। প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের মোহনার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। সাগর থেকে চিংড়ি মাছের ট্রলার ঘাটে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হয়ে যায় তাঁর। ট্রলার থেকে পুরুষ শ্রমিকেরা ‘টুকরি’ বোঝাই করে চিংড়ি মাছ তীরে এনে ফেলে দেওয়ার পর নারীরা মাছের মাথা ফেলে দিয়ে স্তূপ করতে থাকেন। এভাবে মাছ বাছাই করে দিন শেষে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

তবে পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে বেশি কাজ করলেও শোভা রানীর মতো অনেক নারী শ্রমিক মজুরি কম পাচ্ছেন। কাল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের উন্নয়নের জন্য এবং তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা দূর করার জন্য নানা ধরনের কথা বলা হয়। কিন্তু নারী দিবসকে সামনে রেখেও মজুরিসহ নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীর বৈষম্য দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

মজুরিবৈষম্যের শিকার শোভা রানীর বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামে। স্বামী শেখর দাস বছরখানেক আগে মারা গেছেন। ছেলে দিনমজুরির কাজ করেন। টানাপোড়েনের সংসার। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় তিনি তাঁর এক নাতনিকে নিয়ে মাছ বাছাইয়ের কাজ করছেন।

শোভা রানী বলেন, ‘আমরা চিংড়ি মাছের “কল্লা কাটি” (মাছের শরীর থেকে মাধা বিচ্ছিন্ন করা) এবং এই সময় হাতে মাছের কাঁটার খোঁচা লাগে, ক্ষত হয়। অনেক কষ্ট হয় এই কাজ করতে। তারপরও পেটের দায়ে কাজটি করছি। ১ কেজি কাটতে পারলে ১০ টাকা মজুরি পাই। এভাবে প্রতিদিন ১৫৯ টাকা থেকে ২৫০ টাকা মজুরি পাই।’

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের নারী শ্রমিক শোভা রানী
ছবি: প্রথম আলো

রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে শোভা রানীর মতো তিন শতাধিক নারী বছরের পর বছর চিংড়ি মাছ বাছাইয়ের কাজ করছেন, এখানে নারীদের কাজের জন্য কোনো ঘর নেই। তাঁরা খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করছেন। নারীদের মজুরি কম, তাই জেলেরা মাছের ট্রলারগুলোকে এই নদীর পাড়ে এনে মাছ বাছাইয়ের কাজটি করিয়ে নিচ্ছেন।

বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েক শ নারী খোলা আকাশের নিচে বসে চিংড়ি মাছ বাছাই করছেন। দুপুর ১২টার মধ্যে ১৫-১৬টি ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে নোঙর করে। এর আগেই নারী শ্রমিকেরা সারি বেঁধে খোলা মাঠে বসে পড়েন। এরপর পুরুষ শ্রমিকেরা ট্রলার থেকে মাছ উঠিয়ে তীরে ফেলে দেন আর নারী শ্রমিকেরা তা নিজেদের কাছে নিয়ে বাছাই শুরু করেন।

এ সময় নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মজুরিবৈষম্যের এ চিত্র পাওয়া গেছে। এ সময় বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের জামাল মাঝি গ্রামের ফাতেমা আক্তার (৪০) বলেন, এখানে পুরুষদের দৈনিক মজুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। অথচ দৈনিক তাঁদের ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।

তেলীপাড়া গ্রামের নারী শ্রমিক সাফিয়া বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে শ্রমিকের কাজ করি। এখানে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সময় ধরে কাজ করেন। কাজের সময় পুরুষেরা বিশ্রামের সুযোগ পেলেও নারীরা তেমন বিশ্রাম নেন না। কিন্তু পুরুষ শ্রমিকেরা যে টাকা মজুরি পান, আমরা তার অর্ধেকেরও কম পাই।’

আসলেই নারী শ্রমিকরা মজুরি–বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তবে এ ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি। তারপরও আমরা নারীদের শ্রমের মজুরি কম দেওয়ার খবর পেলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কার্যকর পদক্ষেপ নিই।
শাহিদা বেগম. পটুয়াখালী মহিলাবিষয়ক কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী মহিলাবিষয়ক কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শাহিদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলেই নারী শ্রমিকরা মজুরি–বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তবে এ ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি। তারপরও আমরা নারীদের শ্রমের মজুরি কম দেওয়ার খবর পেলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কার্যকর পদক্ষেপ নিই। নারীরা যাতে তাঁদের শ্রমের সঠিক মজুরি পান, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পটুয়াখালী জেলা শাখার সভাপতি শোভা রানী রায় বলেন, ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, একজন নারী শ্রমিক শ্রম দিতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেন। তারপরও নারী শ্রমিকেরা বেশি মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মজুরিবৈষম্য দূর করতে সামাজিক আন্দোলন দরকার। এ ছাড়া নারীদের জন্য শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।’

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্ল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন স্থানে চিংড়ির মাথা কেটে বাছাইয়ের কাজ চলছে। নারী শ্রমিকদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এ কাজ করতে হচ্ছে। যেসব স্থানে মাছ বাছাইয়ের কাজ চলছে, তা চিহ্নিত করে সেখানে শেড নির্মাণ, পৃথক শৌচাগার, পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি নারীদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হবে।