ব্যবহারের আগেই নষ্ট হচ্ছে ‘অপ্রয়োজনে’ কেনা কোটি টাকার আসবাব

  • সাবেক উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের সময়ে বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টাকা দিয়ে খাটগুলো কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

  • ২ হাজার ৬৭০ লোহার তৈরি খাটের মধ্যে ১ হাজার ৮৭০টি বিভিন্ন হলের কক্ষে ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত ৮০০ খাট খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে।

অপ্রয়োজনে কেনা লোহার খাটগুলো পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
প্রথম আলো

মাঠ ভরা পানি। সেখানে স্তূপ করে রাখা আছে কয়েক শ লোহার খাট। কাশবনে ঢেকে আছে সেই স্তূপ। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) একুশে লাইব্রেরি ভবনের পূর্ব পাশে দেখা মিলবে এমন দৃশ্য। ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে এভাবেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে প্রায় ৮০০ খাট। যেগুলো কিনতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ হয়েছে কোটি টাকার বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসন সূত্র বলছে, এসব আসবাব রাখার মতো অবকাঠামো এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গড়ে ওঠেনি। প্রয়োজনের আগেই বেশি দামে কেনা হয়েছিল লোহার খাটগুলো। যেগুলো ব্যবহারের আগেই পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। কর্তৃপক্ষও আসবাবগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে।

খাট সংরক্ষণের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোরকিপার মো. সাইফুল্লাহ রাজু বলেন, ‘স্টোরের জায়গা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনকে গত দুই বছরে প্রায় পাঁচবার চিঠি দিয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঠের বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলগুলো আমরা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। তবে এখনো স্টোরের জায়গা পর্যাপ্ত নয়। জায়গা বাড়ানো হলে খাটসহ অবশিষ্ট আসবাব সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।’

এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোপার্টি (সম্পদ), জনগণের প্রোপার্টি, দেশের প্রোপার্টি। এগুলো এভাবে নষ্ট হতে দেখে আমি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর খাটগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।
অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড ও খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে ১১টি কার্যাদেশের মাধ্যমে মোট ৪ কোটি ৪৮ লাখ ২৭ হাজার ৬২৫ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৬৭০ লোহার তৈরি খাট কেনা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৭০টি খাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের কক্ষে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত ৮০০ খাট খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। প্রতিটি খাটের গড় মূল্য পড়েছে ১৬ হাজার ৭৮৯ টাকা। সেই হিসাবে ৮০০ খাটের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে গুনতে হয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যদিও বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টাকা দিয়ে খাটগুলো কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের একটি লোহার খাট তৈরি করতে সর্বোচ্চ ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা দাম পড়ে বলে গোপালগঞ্জের কয়েকটি দোকানে (ওয়ার্কশপে) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

অপ্রয়োজনে কেনা লোহার খাটগুলো পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
প্রথম আলো

২৪ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিনে দেখা যায়, একাডেমিক ভবনের দক্ষিণ পাশে ও পেছনে খোলা আকাশের নিচে প্রায় ৪০০ খাট পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনিক ভবনের পেছনে, একুশে লাইব্রেরি ভবনের পূর্ব পাশে পানির মধ্যে রাখা হয়েছে আরও ৪০০ খাট। অযত্ন আর অবহেলায় এসব খাট কাশফুলের গাছ ও লতাপাতায় ঢেকে আছে। অনেক খাটে মরিচা ধরেছে। অন্যদিকে গ্যারেজ এবং একাডেমি ভবনের নিচে পড়ে আছে ৪০০ থেকে ৫০০ জোড়া বেঞ্চ, যেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ভবন নির্মাণ না করে এসব আসবাব ক্রয় করার একমাত্র উদ্দেশ্য সরকারি অর্থ লুটপাট করে খাওয়া। শুধু আসবাবই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম–দুর্নীতি হয়। যে যেভাবে পারছে লুটপাট করছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাট বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কেনা হয়েছে। সঠিকভাবে তদন্ত করে এ ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাঁদের।

অপ্রয়োজনে কেনা লোহার খাটগুলো পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক এম এ সাত্তার বলেন, সাবেক উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের নির্দেশেই অতিরিক্ত খাট ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি পরবর্তী সময়ে কার্যাদেশের জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি অগ্রিম অর্থ দিতে রাজি হননি। পরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব বলেন, ‘এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোপার্টি (সম্পদ), জনগণের প্রোপার্টি, দেশের প্রোপার্টি। এগুলো এভাবে নষ্ট হতে দেখে আমি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর খাটগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া আরও কিছু মূল্যবান আসবাব ও সোফা অস্থায়ী স্টোর রুমে নষ্ট হচ্ছে। সেগুলো সংরক্ষণ করছি।’

খাট কেনায় অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আগেই এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করেছে। এ বিষয়ে তিনি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রিজেন্ট বোর্ড প্রয়োজনে এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে।