জামালপুরের মাদারগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে ভোটারদের বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদস্যপদে ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারলেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীর কর্মীদের উপস্থিতিতে নৌকায় সিল মারতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ভোটারদের।
আজ রোববার চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোট গ্রহণের পর উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। মাদারগঞ্জ উপজেলায় সাতটি ইউনিয়নে নির্বাচন হচ্ছে। তবে চারটিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। ফলে কড়ইচড়া, গুনারীতলা ও সিধুলী ইউপিতে সব পদে ভোট হচ্ছে। কড়ইচড়া ও গুনারীতলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দুই প্রার্থী। সিধুলীতে নৌকার প্রতিপক্ষ দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কড়ইচড়া ইউপির ভেলামারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে বিশৃঙ্খল অবস্থা। ভোটারের সঙ্গে বহু বহিরাগত লোকজন। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ভোট গ্রহণের বুথের মধ্যে ব্যাপক মানুষের জটলা। এসব নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কাউকে কোনো রকম তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে প্রতিটি বুথের সামনে ভোটারের লম্বা লাইন।
কয়েকজন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে শুধু ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যদের ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। চেয়ারম্যান পদে ভোট নৌকার লোকজনকে দেখিয়ে দিতে হয়। কেউ ইচ্ছা করলেও না দেখিয়ে দিতে পারছেন না। পুরো কেন্দ্রের কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মো. মিনহাজুল ইসলামের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এস এম নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মাঠে পরিবেশ এখনই ঠিক করা হবে। চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে নৌকার লোকজনকে দেখিয়ে সিল দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
একই ইউনিয়নের ভাংবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও একই রকম। ওই কেন্দ্রের মাঠে কয়েকজন বয়স্ক ভোটারের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দুর্বল এক প্রার্থী। তারপরও নৌকার লোকজন ঝুঁকি নিচ্ছেন না বা ভোটারদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। ফলে চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে নৌকার লোকজনকে দেখিয়ে সিল দিতে হচ্ছে। তাহলে বুঝেন কেমন ভোট হচ্ছে। এসব কয়েকটি বুথ ঘুরে দেখার চেষ্টা করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বুথের কক্ষে ঢুকতে দেননি।
দুপুর ১২টার দিকে গুনারীতলা ইউপির উত্তর জোরখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে দেখিয়ে সিল দেওয়ার কথা বলেন ভোটাররা। সেখানেও ভোটের মাঠে কোনো রকম শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো ঘোরাফেরা করছেন।
বেলা একটার দিকে একই ইউপির জোরখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্র প্রায় ভোটার শূন্য দেখা যায়। তবে বুথের ভেতর কিছু লোকজনের জটলা দেখা গেল। সেখানেও দেখা গেল, একজন ভোট দিচ্ছেন, অন্য আরেকজন তাঁর সঙ্গে বুথের ভেতর। পরে জানা গেল, চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে নৌকার সিল নিশ্চিত করতেই আরেকজন বুথে ঢুকেছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান। তিনি দাবি করেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। একই মাঠে ইসলামাবাদ ওয়াসিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের অবস্থাও একই রকম।
ওই কেন্দ্রে একজন তরুণ ভোটারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের শিক্ষার্থী। তিনি ভোটের চিত্র নিয়ে বলেন, এটা কোনো ভোট হলো? নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারপরও নৌকার প্রার্থীর লোকজনদের ভয়। এ ভয় যদি তাঁরা হেরে যায় বা ভোটাররা তাঁদের ভোট না দেন। ফলে চেয়ারম্যান পদের ভোট তাঁরা দেখে নিশ্চিত করে নিচ্ছেন।
কড়ইচড়া ইউপিতে ইসলামী আন্দোলনের চেয়ারম্যান প্রার্থীর মো. মিনহাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা কোনো নির্বাচন হতে পারে না। এটি একটি নাট্যমঞ্চ। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমার ভাই ও মায়ের ভোটটিও নৌকা প্রার্থীর লোকজনেরা তাঁদের সামনে জোর করে নৌকায় সিল মেরে নিয়েছেন। কোনো কেন্দ্র এজেন্ট দিতে দেননি তাঁরা। আগে থেকেই ভয়ভীতি দেখিয়েছেন।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্যে কড়ইচড়া ইউপিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মোজাম্মেল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। গুনারীতলা ইউপির নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানকেও মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, চেয়ারম্যান পদের ব্যালট দেখিয়ে সিল মারার বিষয়ে কোনো প্রার্থী মৌখিক বা লিখিত কোনো অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে সব জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।