বয়স্ক ভাতা পেতে ৪২ হাজার টাকা ঘুষ

রঞ্জন বিশ্বাসের বয়স ৫৮ বছর। আর তাঁর স্ত্রী যমুনা বিশ্বাসের বয়স ৪৫। দুজনই পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা। অথচ বয়স্ক ভাতা পেতে পুরুষের বয়স কমপক্ষে হতে হবে ৬৫ এবং নারীর ৬২ বছর। দেড় বছর আগে থেকে তাঁরা হয়েছেন এই ভাতাভোগী। অনিয়ম করে ওই দম্পতির এই ভাতা সুবিধা পাইয়ে দিতে তাঁদের কাছ থেকে ৪২ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওই দম্পতির বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নড়াগাতী থানার মাউলি ইউনিয়নের মহাজন গ্রামে। তাঁদের এখন আশঙ্কা, উপকারভোগীর তালিকা থেকে তাঁরা বাদ পড়বেন। বিপদেও পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় ঘুষের বিনিময়ে যাঁরা ভাতা পেতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যমুনা বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর করা ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, মহাজন গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর খান ৪২ হাজার টাকা উৎকোচ নিয়ে তাঁদের বয়স্ক ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এ বিষয়ে প্রথম আলোকে যমুনা বিশ্বাস বলেন, জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভালো সম্পর্ক। তিনি ৪২ হাজার টাকা নিয়ে ওই ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর খান তখন বলেছিলেন, ‘এই কার্ড কোনো দিনই বাদ হবে না।’

যমুনা বিশ্বাস আরও বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পাঠখড়ি বেচে (বিক্রি), জাল বুনে ও ২০ হাজার টাহা সুদে আনে ওই ৪২ হাজার টাহা দিছিলাম। সুদির টাহা হ্যান্নেও শোধ করতি পারি নাই। অনেকেই ছাগল-গরু বেচে ও সুদে টাহা আনে ভাতার কার্ড করিছে।’

জাহাঙ্গীর খান মাউলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য। অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ সঠিক নয়। এসবের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, মাউলি ইউনিয়নে অন্তত তিন শ ব্যক্তি অবৈধভাবে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও তাঁদের সঙ্গে সখ্য আছে এমন ব্যক্তিরা টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে এসব ভাতার বই করে দিয়েছেন। বয়স হয়নি, তবু তাঁরা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। আবার বিধবা ও প্রতিবন্ধী নন, তাঁরাও বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। ঘুষ দিতে না পারায় এসব ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে মহাজন গ্রামের বাসিন্দা নড়াগাতী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি উত্তম কুমার সাহাও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, বৈধ বা অবৈধ যা–ই হোক, মাউলি ইউনিয়নে মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া ভাতা বই হয় না। এসব ভাতা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে হয়।

কালিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতি মাসে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা ৫০০ টাকা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা ৭৫০ টাকা দেওয়া হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা অনুযায়ী, যাচাই-বাছাই শেষে সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে এসব ভাতা বই করে দেওয়া হয়।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মহাজন গ্রামের গুরুরানী বিশ্বাস (৫৫) বিধবা না হয়েও পাচ্ছেন বিধবা ভাতা। ওই গ্রামের খোকন দাস (৩৭) ও তাঁর ভায়রা নৃপেন সাহা (৫০) পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা।

গুরুরানী বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন মেম্বার ১২ হাজার টাহা নিয়ে বিধবা ভাতা করে দেছে। আমি বিধবা না। বয়স্ক ভাতা করে দিতি চাইয়ে বিধবা ভাতা করে দেছে। আমি গরিব মানুষ। সুদে টাহা আনে টাকা দিছিলাম। আগে জানলি এর মধ্যি যাতাম না।’ খোকন দাস বলেন, ‘৬৫ বছর বয়সের আগে বয়স্ক ভাতা হয় না, তা আগে জানতাম না।’

মাউলি ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সুজল ঠাকুর প্রথম আলোকে বলেন, মাউলি ইউনিয়নে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী আছেন প্রায় ১ হাজার ৩০০। এর মধ্যে অন্তত তিন শ হবে অবৈধ। এখন অবৈধরা বাদ পড়বেন এবং যাঁরা পাওয়ার উপযুক্ত, তাঁরা এ বছরের মধ্যে ভাতা পেয়ে যাবেন।

মাউলি ইউপি চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যতটা অনিয়ম–দুর্নীতির কথা শুনেছেন, ততটা নয়। কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা সমাজসেবা দপ্তর থেকে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।