ভটভটিতে বসবাস রেখা বিবিদের
‘ছ্যাওয়াল পোয়ালকে আত্মীয়র বাড়িত দিইয়া পাঠায়্যা আমরা গরু নিয়ে সড়কের ওপর ভটভটিতে ঘর বানিয়ে থাকছি। কেউ আমারির খোঁজখবর ল্যেয়নি।’ এসব কথা বলেন পাঁচ দিন ধরে বিধবা বোন আর স্বামীকে নিয়ে ভটভটিতে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসবাস করা রেখা বিবি (৩২)।
রেখা বিবির বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বড় বিহানালী ইউনিয়নের ইটাবাড়ি গ্রামে। শুধু তিনি একা নন, তৃতীয় দফার বন্যায় তাঁর মতো শত শত পরিবার এভাবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।
উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও অতিবৃষ্টিতে উপজেলায় ওই তৃতীয় দফার বন্যা দেখা দেখা দেয়। এ সময়ে উপজেলার দ্বীপপুর, বড় বিহানালী, কাচারীকোয়ালীপাড়া, ঝিকড়া, মাড়িয়া, যোগীপাড়া ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়। এতে পুকুর, দিঘি, বিল ও ঘেরের মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও ফসল তলিয়ে যায়। শতাধিক কাঁচা ঘর ধসে পড়ে।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে বড় বিহানালী ইউনিয়ন এলাকায় গিয়ে বন্যাকবলিত লোকজনের দুর্ভোগ দেখা যায়। গোটা ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। পানির নিচে রয়েছে অধিকাংশ গ্রাম। লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু স্থানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। অনেকে সড়কের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন পরিবার নিয়ে। এই ইউনিয়নের বাঘাবাড়ি বাজারের পাশে উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়া রেখা বিবি বলেন, বন্যার পর পাঁচ দিন আগে স্বামী, বিধবা বড় বোন ও গরু নিয়ে এসেছেন। রাতের বেলা তিনজন গাদাগাদি করে ভটভটিতে থাকেন। ভটভটির ওপরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি। একই কথা বলেছেন, তাঁর বিধবা বোন সালেহা বেগম (৬২)।
বড় বিহানালী ইউনিয়নের বেড়াবাড়ির ইটাবাড়ি এলাকার প্রায় ৩৪টি পরিবার পানির নিচে বসবাস করছেন। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকাতে অনেকে বাড়িতেই বসবাস করছেন। রান্নার অভাবে তিনবেলা খাবার খেতে পারছেন না এসব পরিবারের সদস্যরা। সাইফুল ইসলাম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি জানান, তাঁর ঘরের ভেতরে কোমরপানি। নিরুপায় হয়ে ঘরের তীরের সঙ্গে খাট ঝুলিয়ে হাঁস-মুরগি নিয়ে সেখানেই থাকছেন। এ ছাড়া বাড়ির টিনের চালার ওপর খাবার দিয়ে সেখানে মুরগি রেখেছেন। সরেজমিনে গিয়ে ঘরের চালার ওপর কিছু মুরগি এবং ঘরের ভেতরে পানিতে হাঁস ভাসতে দেখা যায়। তাঁর বাড়ির পেছনে ডুবে যাওয়া প্রাচীরে তিনটি সাপকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তিনি বলেন, সাপও অসহায় হয়ে পড়েছে। সাপের ভয় থাকলেও সেখানেই বসবাস করতে হচ্ছে তাঁদের। সাজেদা বেগম (৫৪) নামের এক গৃহবধূ জানান, বন্যার পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে একটি খাটের ওপর আরেকটি খাট রেখে সেখানে কোনো রকম থাকছেন। তবে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সড়কে সেগুলো রেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন।
উপজেলার বড় বিহানালী ইউনিয়নের ইটাবাড়ি গ্রামের এলাকার মহরম হোসেন (৪৮) নামের এক ব্যক্তি বলেন, তাঁর বাড়ি এখন পানির নিচে। বাড়ির কিছু মালামাল মাচা করে সেখানে রাখতে পেরেছেন। কিছু মালামাল ভেসে গেছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি বলে জানান তিনি।
বড় বিহানালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সোলাইমান আলী (৭৯) বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় এত বড় বন্যা আর ক্ষয়ক্ষতি কখনো দেখেননি। তাঁর এলাকার ফসল, পুকুর, দিঘি, মাছের ঘেরসহ বাড়িঘরও ভেসে গেছে। এলাকার লোকজন তৃতীয় দফা বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বড় বিহানালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁর এলাকায় অন্তত ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। লোকজন পানিতে ডুবছে। সরকারিভাবে ২০০ জনের জন্য মাত্র ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আগামী রোববার সেগুলো বিতরণ করা হবে। শুকনো খাবার বা অন্য কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।