ভাঙনের পর অশেষ দুঃখে কাটছে দিন

২০১৮ সালে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হয় নড়িয়া উপজেলার ৫ হাজারের বেশি পরিবার। দুই বছর পরও তাদের পুনর্বাসন হয়নি।

স্বামী গুপিনাথ বাছার দুই বছর আগে পদ্মার ভাঙনে নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন। এরপর তাঁর আর খোঁজ মেলেনি। নিখোঁজ স্বামীর ছবি নিয়ে এভাবে প্রায়ই বসে থাকেন স্ত্রী পার্বতী বাছার। গত ২৭ নভেম্বর শরীয়তপুরের নড়িয়ার কেদারপুরেছবি: জহির রায়হান

পদ্মাপারে বসবাস প্রায় ৪৫ বছর। তবু নদীটিকে বুঝে উঠতে পারছেন না আবু বক্কর সিদ্দিক। বললেন, ‘গাঙ্গের গতিবিধির ঠিক নাই। কখন কোন দিক দিয়া আইসা ভাইঙা নিয়া যায়।’ হয়েছেও তা-ই। আবু বক্করের পরিবার পদ্মার ভাঙনের মুখে পড়েছে দুবার। ১৯৯২ সালে প্রথম। দ্বিতীয়বার ২০১৮ সালে।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে আবু বক্করের চা, পান-বিড়ির দোকান ছিল। বাড়ি ছিল কেদারপুর ইউনিয়নের চর জুজিরাতে—দুই ঠিকানাই বিলীন হয়েছে ২০১৮ সালে পদ্মার তীব্র ভাঙনে। ভিটাবাড়ি হারিয়ে আবু বক্কর স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নদীর কাছে ভাড়া করা জমিতে। মা ও ছোট ভাই থাকছেন ১০ কিলোমিটার দূরে লোনসিং গ্রামে।

গত ২৭ নভেম্বর শেষ বিকেলে আবু বক্করের সঙ্গে দেখা। তখন তিনি কিনারে বসে পদ্মার শান্ত রূপ দেখছিলেন। বললেন, তাঁর মতো নদীভাঙনের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে সে সময় সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু সেই সহযোগিতা কমে গেছে। তাঁরা এখন দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

নড়িয়া উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে, ২০১৮ সালে নড়িয়া পৌরসভা এবং নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, মোক্তারের চর ও ঘড়িষাড় ইউনিয়নের ৫ হাজার ১৯টি পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। পদ্মায় পুরো বিলীন হয়েছে আটটি গ্রাম—চর নড়িয়া, বসাকের চর, চর জুজিরা, বাঁশতলা, ওয়াপদা, সাধুর বাজার, শেহের আলী মাদবরকান্দি ও ঈশ্বরকাঠি। ৮০ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে কেদারপুর ও পূর্ব নড়িয়া গ্রাম দুটি।

এই তালিকা ধরে ২০১৯ সালের জুনে মাঠপর্যায়ে জরিপ করে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)। গত অক্টোবরে প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদন বলছে, পরিবারগুলোর অর্ধেকের বেশি উদ্বাস্তু হয়েছে। তারা কাজ হারিয়েছে। আয় কমে গেছে। সে সময় তারা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেয়েছিল, কিন্তু স্থায়ী পুনর্বাসন হয়নি।

শরীয়তপুর-২ আসনের সাংসদ পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালে নড়িয়া উপজেলা ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়লে সরকার নদীভাঙন রোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল। ভাঙন ঠেকাতে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মার ডান তীরে বাঁধ নির্মাণকাজ চলছে। ফলে নদীভাঙন থেমে গেছে।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী আরও বলেন, ভাঙনের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, দুর্যোগসহনীয় ঘর তৈরি করে দেওয়াসহ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিদেরও পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

নড়িয়া উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে, ২০১৮ সালে নড়িয়া পৌরসভা এবং নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, মোক্তারের চর ও ঘড়িষাড় ইউনিয়নের ৫ হাজার ১৯টি পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। পদ্মায় পুরো বিলীন হয়েছে আটটি গ্রাম। ৮০ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছে দুটি গ্রাম।

সরেজমিনে এক দিন

২০১৮ সালে নড়িয়ায় নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো কেমন আছে, তা দেখতে সেখানে যাই গত ২৭ নভেম্বর সকালে। নড়িয়ার ৩০০ বছরের পুরোনো মূলফৎগঞ্জ বাজার। সেখানে থেকে পদ্মাকে দেখা গেল অনেকটা স্থির। ছোট ছোট ঢেউ। স্রোত নেই। বাজার থেকে পদ্মার ডান তীরে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, ওপারে ১ কিলোমিটার দূরে বিশাল চর। চরটির নাম চর জুজিরা। ২০১৮ সালের আগে এটি ভরা গ্রাম ছিল।

স্থানীয় নাসির ব্যাপারী বললেন, নদীভাঙনে চর জুজিরা গ্রামটি পুরো নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। নদী ভাঙতে ভাঙতে মূলফৎগঞ্জ বাজার পর্যন্ত এসেছিল। এখানেও ভেঙেছে ৩০০ দোকান। পরে বালু পড়ে চর জুজিরা আবার জেগেছে।

নাসির ব্যাপারীর সঙ্গে বাজার থেকে পূর্বে পদ্মার নির্মাণাধীন ডান তীর রক্ষা বাঁধ ধরে হাঁটি। ভাঙনের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন পড়ে আছে। কারও বাড়ি অর্ধেক নদীতে গেছে, বাকি অর্ধেক নদীর কিনারে ঝুলছে। কারও বাস্তুভিটা খালি পড়ে আছে, ঘর নেই।

নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনটি ভবন বিলীন হয়েছিল। বাকি আটটি ভবনে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। হাসপাতালের নতুন রং করা ভবনগুলো দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই, ভাঙনের দিনগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল।

হাসপাতাল থেকে ১০০ মিটার এগোলে নাসির ব্যাপারীর বাড়ি। সাধুর বাজারে তাঁর চায়ের দোকান ছিল, আবাদি জমি ছিল ২ একর। এখন কিছুই নেই। ছোটখাটো গৃহস্থ থেকে তিনি এখন দিনমজুর।

নাসির ব্যাপারী আশ্রয় নিয়েছেন উত্তর কেদারপুরের একটি বাগানবাড়িতে। তাঁর পরিবারের মতো এখানে ঠাঁই নিয়েছে আরও ৫৪টি পরিবার। নদীভাঙনের সময় তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিল স্থানীয় লস্কর পরিবার।

লস্করদের বাগানবাড়িতে নারী-পুরুষ-শিশু মিলে লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই শ। বেশির ভাগ খুপরি। একচালা। নাসির ব্যাপারীর স্ত্রী রোজিনা বেগমের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেমন আছেন? উত্তর আসে, ‘ঘরে ঘরে অভাব। কান্দন ছাড়া কিছু নাই।’

ভাঙনের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, দুর্যোগসহনীয় ঘর তৈরি করে দেওয়াসহ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিদেরও পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
এ কে এম এনামুল হক, শরীয়তপুর-২ আসনের সাংসদ ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী

ভাড়া জমিতে অস্থায়ী বাস

শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলা নদীভাঙনের জনপদ। গত ২০ বছরে এই দুই উপজেলার অন্তত ৩৫ হাজার পরিবার নদীভাঙনে গৃহহীন হয়েছে। অস্থায়ী আশ্রয় পেতে তাদের তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। চরে অথবা আবাদি জমিতে তারা ঘর করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. সামছুদ্দোহা বললেন, জায়গার সংকটের কারণে এখন সেই সুযোগ কমে গেছে।

নদীভাঙনের শিকার হয়ে নড়িয়া পৌরসভার পূর্ব নড়িয়া গ্রামে থাকছে কাঠমিস্ত্রি শফিকুলের পরিবার। তিনি ২ শতক জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। তাতে একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি টয়লেট বানিয়েছেন। কিন্তু জমিটা নিচু। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি ওঠে। বিদ্যুৎ নেই। পানির কল নেই। শফিকুল বলেন, খাওয়ার পানি অন্যের বাড়ি থেকে এনে খান। শীতকালে সেই পানিও কমে গেছে। ‘ম্যালা সমস্যায় আছি।’

চর জুজিরা গ্রামের সুমন খালাসি সরকার থেকে টিন ও নগদ ৬০০০ টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু জমির অভাবে ঘর তুলতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তিনি নড়িয়া পৌরসভার পূর্ব নড়িয়া গ্রামে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়া বাবদ মাসে ২০০০ টাকা দিতে হয়।

নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন ভেদরগঞ্জের ইউএনও তানভীর আল নাসিফ। তিনি বলছেন, ভাঙনের শিকার মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প হলেও সমস্যা অন্যখানে। তাঁরা জীবিকা ছেড়ে আশ্রয়ণের জন্য নতুন ঠিকানায় উঠতে চাইছেন না। যেখানে জীবিকা, তাঁরা সেদিকে ছুটে যাচ্ছেন।

ভাঙনকবলিত মানুষের মধ্যে ভীষণ অভাব আছে। তাই তাঁরা এনজিওর দ্বারস্থ হচ্ছেন।
রাবেয়া বেগম, নির্বাহী পরিচালক, ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস)

বেশির ভাগ পরিবার ঋণগ্রস্ত

লস্করদের বাগানবাড়িতে ঠাঁই নেওয়া বিধবা সেলিনা বেগমের তিন ছেলে। বড় দুই ছেলে জুলহাস ও হুমায়ুনের খানা আলাদা। ছোট ছেলেকে রুমানকে নিয়ে মা-ছেলের সংসার। সেলিনা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে চলতেন। কিন্তু এখন আর পারেন না। তাঁর পায়ে বাত ধরেছে।

সংসারের খরচ চালাতে সেলিনা এনজিও আশা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু কিস্তি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনি বললেন, ‘ছোট ছেলে ফার্নিচারের কাজ শিখেছে। সপ্তাহে ৩০০-৪০০ টাকা পায়। তা দিয়া কোনোমতে খাওয়া চলে। কিস্তি দিব কী দিয়া?’

হালিমা থাকেন পাশের ঘরটিতে। স্বামী বাবুল মাঝি রিকশা চালান। সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। আরও ৩০ হাজার টাকা দেনা আছে এক আত্মীয়ের কাছে, ভাঙনের সময় নিয়েছিলেন। কোনো ঋণই শোধ করতে পারেননি।

স্থানীয় এনজিও শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (এসডিএস) নির্বাহী পরিচালক রাবেয়া বেগম বলছেন, ভাঙনকবলিত মানুষের মধ্যে ভীষণ অভাব আছে। তাই তাঁরা এনজিওর দ্বারস্থ হচ্ছেন।

পেশা হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে

নদীতীরবর্তী বেশির ভাগ পরিবারের জীবিকা কৃষি ও নদীনির্ভর। ভাঙনের পর কৃষিজমি হারিয়ে অনেক গৃহস্থ পরিবার এলাকা ছেড়েছে। জীবিকার সন্ধানে দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়াচ্ছে।

কেদারপুর গ্রামের হারুন হাওলাদার যেমন কাজ করছেন ঢাকার অ্যালুমিনিয়াম কারখানায়। তাঁর ছোট ভাই আইনুল হাওলাদার গেছেন দুবাইতে। বাকি তিন ভাইও কাজের খোঁজ করে যাচ্ছেন। একই গ্রামের সুমন খালাসি স্ত্রী-সন্তানদের শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাজের সন্ধানে তিনিও গেছেন ঢাকায়।

সে সময়কার নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বললেন, এই পরিবারগুলো খুব বেশি সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়নি। সে জন্য কাজের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিটি ঘরে শিক্ষিত ছেলে আছে। তাঁদের জন্য চাকরির সুযোগ এবং সহজ শর্তে ঋণ দিলে অনেকের কর্মসংস্থান হতো।

নদীতীরবর্তী বেশির ভাগ পরিবারের জীবিকা কৃষি ও নদীনির্ভর। ভাঙনের পর কৃষিজমি হারিয়ে অনেক গৃহস্থ পরিবার এলাকা ছেড়েছে। জীবিকার সন্ধানে দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়াচ্ছে।

নিখোঁজেরা ফিরে আসেনি

বাংলা সনের দিন-তারিখ পার্বতী বাছারের মুখস্থ। ১৪২৫ বঙ্গাব্দের ২১ শ্রাবণ তাঁর স্বামী গুপিনাথ বাছার পদ্মার স্রোতে ভেসে গেছেন। আর ফিরে আসেননি।

পার্বতীও আশ্রয় নিয়েছেন লস্করদের বাগানবাড়িতে। থাকার ঘরে স্বামীর একটি ছবি বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রেখেছেন। সেটি দেখিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ মানুষটা নাই হয়া গেল। দুই বৎসর হইল, কত মনে পড়ে, ছবি দেখি আর থাকি।’

গুপিনাথের চা-দোকান ছিল মূলফৎগঞ্জ বাজারে। ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট সাধুর বাজারে ভয়াবহ ভাঙন চলছিল। লোকজন ও ঘরবাড়ি উদ্ধার করতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তীরের প্রায় ২০০ মিটার নিমেষেই ধসে গেলে নদীতে নিখোঁজ হন ৭ জন। পরে মাদারীপুরের শিবচরে ২ জনের মরদেহ ভেসে ওঠে। অন্যদের হদিস পাওয়া যায়নি। গুপিনাথ তাঁদের একজন।

পার্বতী বললেন, স্বামীর লাশ না পাওয়ায় তিনি কোনো সরকারি সহযোগিতা পাননি। তবে স্থানীয় সাংসদের পক্ষ থেকে ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন থেকে এক লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন।

তাঁদের দুই ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বড় ছেলে অন্তর (১৭) কাজ করছে শরীয়তপুর শহরের একটি গ্যারেজে। ছোট ছেলে হৃদয় (১৪) কাজ করছে গ্রামের একটি খাবার হোটেলে।

অসুখের সঙ্গে বসবাস

নদী ভেঙেছে শাহিদার সংসার। তার ওপর স্বামী শরীফ খান ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে আয়হীন সংসার। স্বামীর চিকিৎসা করতে আশা এনজিও থেকে তুলেছেন ৩০ হাজার টাকা। সেই টাকায় চিকিৎসা চলছে। কিন্তু কত দিন? শাহিদার চোখমুখে ঘোর অন্ধকার।

ইশাতন নেসার বয়স কম করে হলেও ৮০। ভাঙনের সময় তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে বিছানায় পড়েছেন। তখন থেকে বিছানায়। এত দিন তাঁর দেখাশোনা করছিলেন পুত্রবধূ নুরুনেচ্ছা। তিনিও এখন ভুগছেন শ্বাসকষ্টে। এই শীতে তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। টাকার অভাবে কেউই চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

৬৫ বছরের ধুলু খালাসী আগে পাটখড়ি, লাকড়ি বিক্রি করতেন। বয়সের ভারে এখন কাজ করতে পারেন না। তাঁর ছেলে রবীন খালাসী বাক্‌ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। নদীভাঙনের পর থেকে আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় চলছেন। এর মধ্যে স্ত্রী রুনিরা বেগম হার্ট ও ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। ধুলু খালাসী বললেন, স্ত্রীর চিকিৎসা করার সামর্থ্য তাঁর নেই।

চল্লিশোর্ধ্ব সুজন খালাসী পেশায় ছিলেন ফল ব্যবসায়ী, নেশায় বাউলশিল্পী। নদীতে তাঁর বাড়ি গেছে। সঙ্গে দোকানও। পরিবারসহ ঠাঁই নিয়েছেন উত্তর কেদারপুরে। বছরে এক শতক জমির ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার টাকা।

পেশা হারিয়ে মূলফৎগঞ্জ বাজারে সুজন খালাসী এখন মহাজনের সবজি-কাঁচামাল বিক্রি করে দেন। বিনিময়ে যেদিন কাজ করেন সেদিন দুই শ থেকে আড়াই শ টাকা পান। এর মধ্যে এক বছর ধরে তিনি হার্নিয়া রোগে ভুগছেন। অপারেশন করতে পারছেন না। সব মিলে তিনি অনেকটাই বিষাদগ্রস্ত।

নদীভাঙনের শিকার হওয়া মানুষদের কথায় বারবার উঠে এসেছে, ভাঙনের পর তারা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন সত্যি, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সে সময় সাহায্য দিলেও এখন কেউ খোঁজ নেন না।

বন্দোবস্ত দরকার দীর্ঘ মেয়াদের

নদীভাঙনের শিকার হওয়া মানুষদের কথায় বারবার উঠে এসেছে, ভাঙনের পর তারা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন সত্যি, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সে সময় সাহায্য দিলেও এখন কেউ খোঁজ নেন না।

তবে ভারপ্রাপ্ত ইউএনও তানভীর আল নাসিফ বলছেন, এই পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি গত তিন বছরে পাঁচ শতাধিক পরিবারের জন্য খাসজমি দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেক কৃষক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. সামছুদ্দোহার মতে, নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর দুরবস্থা কাটাতে তাদের দিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা। তাদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে, কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এখানকার আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে।