ভারতে যা সিনেমা, তা লালমনিরহাটে বাস্তব

করোনার টিকা নিবন্ধন করতে গিয়ে স্কুলশিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত রায় জানলেন, তিনি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু কীভাবে?

লক্ষ্মীকান্ত রায়
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ভারত লাল। বিয়েশাদিতে ব্যান্ড বাজান। ঋণের জন্য গেছেন ব্যাংকে। ব্যাংক জমির দলিল চেয়েছে। ছুটলেন ভূমি অফিসে। গিয়ে তো আক্কেলগুড়ুম! সেখানকার কাগজপত্রে তিনি মৃত। তাঁর জমিজমা সব চাচাতো ভাইদের নামে।

লক্ষ্মীকান্ত রায়। পেশায় স্কুলশিক্ষক। করোনার টিকার নিবন্ধন করবেন। গেছেন স্থানীয় কম্পিউটারের দোকানে। নিবন্ধন নিচ্ছে না। ইন্টারনেট সমস্যা? গেলেন আরেক দোকানে। হলো না। আরও দু–এক দোকানির চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। গেলেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। গিয়ে জানলেন, তিনি মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে!

প্রথম ঘটনাটি হিন্দি সিনেমার। নাম কাগজ। মুক্তি পেয়েছে গত ৭ জানুয়ারি। দ্বিতীয় ঘটনাটি একেবারেই বাস্তব। ঘটেছে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে। জানাজানি হয়েছে গত ২২ ফেব্রুয়ারি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কাকেয়া টেপা গ্রামের বাসিন্দালক্ষ্মীকান্ত রায়। আদিতমারীর বালাপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক তিনি। টিকা নিবন্ধনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র ‘অকার্যকর’ দেখালে তিনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে জানানো হয়, ২০১৪ সালের ৩ জুন তিনি মারা গেছেন। তাই তালিকা থেকে তাঁর নামও বাদ দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, স্থানীয় মন মোহন রায় নামের এক ব্যক্তি ২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীকান্তের ভোটার আইডি নম্বর দিয়ে তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেন। আবেদনে মন মোহন নিজেকে লক্ষ্মীকান্তের ভাই উল্লেখ করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষকের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়। যাচাইপত্রে স্বাক্ষর আছে মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানেরও। তৎকালীন সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আফতাব উজ্জামানের অনুমোদনে তালিকা থেকে লক্ষ্মীকান্তর নাম বাদ দেওয়া হয়। আফতাব উজ্জামান এখন নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।

লক্ষ্মীকান্ত রায়ের অভিযোগ, মন মোহন রায়ের সঙ্গে জমি নিয়ে তাঁর বিরোধ আছে। মামলাও চলছে। এ কারণেই মন মোহন এমন কাজ করেছেন। মন মোহন তাঁর প্রতিবেশী।

তবে মন মোহন রায় বলেন, লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ থাকার কথা সত্য; কিন্তু তিনি ভোটার তালিকা থেকে লক্ষ্মীর নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করেননি।

যে স্কুলশিক্ষক লক্ষ্মীকান্তের কথিত মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন, তাঁর নাম মো. মোমিনুর রহমান। তিনি সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের ধাইরখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জানতে চাইলে মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাকেয়া টেপা গ্রামের মন মোহন রায়ের মাধ্যমে অবহিত হয়ে লক্ষ্মীকান্ত রায়ের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তনের সুপারিশ করেছি।’ জীবিত লোককে মৃত দেখিয়ে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা ভোটার তালিকা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। এই তথ্য জানালে মোমিনুর রহমান বলেন, ‘তাঁরা একই গ্রামের, দুজনের বংশপদবিও এক। তাই মন মোহনের কথা বিশ্বাস করেছি।’

চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি লক্ষ্মীকান্ত রায়ের মৃত্যুসংক্রান্ত কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেননি। এমন কিছু হয়ে থাকলে তা জাল।

আর আফতাব উজ্জামান প্রথম আলোকে বললেন, ‘নাম কর্তনের আবেদনে সবার শেষে রেজিস্ট্রেশন অফিসার হিসেবে আমাকে স্বাক্ষর করতে হয়। যিনি নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করেছেন, যিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যাচাই করেছেন, তাঁরা ভুল তথ্য দিলে অফিসে বসে আমার পক্ষে তা ধরা কঠিন।’

লক্ষ্মীকান্ত রায় জানান, ২০১৬ সালে মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৯ সালে লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি তিনি। তখন মনে করেছিলেন, ভুল করে হয়তো কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম আসেনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার বর্তমান নির্বাচন কর্মকর্তা আজাদুল হেলাল বলেন, লক্ষ্মীকান্ত রায়সহ লালমনিরহাট সদর উপজেলার আটজন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে বাকিদের পরিচয় তিনি প্রকাশ করেননি।

২২ ফেব্রুয়ারি ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি সমাধানের জন্য নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছেন লক্ষ্মীকান্ত রায়। নির্বাচন কর্মকর্তা বলেছেন, বিষয়টি সুরাহা করতে একটু সময় লাগবে।

সেই হিন্দি ছবি কাগজ–এ সমস্যার কী সমাধান দেখানো হয়েছে? সিনেমায় ভারত লাল ছিলেন দেশটির উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা। তার চরিত্রটির রূপদান করেছেন অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠী। সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরেও সমাধান না পেয়ে তিনি ভাবলেন, এমন কিছু করতে হবে, যাতে থানায় তার নামে মামলা হয়। এতে সরকারি কাগজে তাকে জীবিত দেখানো হবে। কিন্তু সে চেষ্টায়ও তিনি ব্যর্থ হন। যোগাযোগ করেন স্থানীয় এক রাজনীতিকের সঙ্গে। তিনি ভারত লালকে ব্যবহার করেন নিজের প্রচারে। দেখান, তিনি ভুক্তভোগীদের পাশে থাকেন। একপর্যায়ে একই রকম আরও কিছু ভুক্তভোগী পেয়ে যান ভারত লাল। নিজেদের ‘জীবন্ত দাহ’ করার প্রতীকী কর্মসূচি নেন তারা। গণমাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা এক কাগজে বলা হয়েছে, ভারত লাল মৃত নয়, জীবিত।

লালমনিরহাটের লক্ষ্মীকান্ত রায়কে সে পথে যেতে হবে না। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এক মাসের মধ্যে সমাধান না করে দিলে তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করবেন।