ভালো নেই রূপগঞ্জের জামদানিশিল্পীরা

রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ায় বিসিক শিল্পনগরী জামদানিপল্লিতে কর্মরত কারিগরেরা।প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ নোয়াপাড়া জামদানিপল্লির তাঁতি মানিক মিয়া (৪৭)। কৃষক পরিবারের অভাব ঘোচাতে ছেলেবেলায় নরসিংদী থেকে এসেছিলেন নোয়াপাড়ায়। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ৪০ বছর। জীবনে অসংখ্য জামদানিতে রঙিন নকশা বুনেছেন মানিক। কেবল আগের মতোই বিবর্ণ তাঁর জীবনের নকশা। ৪০ বছর পরও মানিকের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

মানিকের মতোই দশা রূপগঞ্জের অধিকাংশ জামদানি তাঁতির। দেশ-বিদেশে জামদানির কদর বাড়লেও তাতে লাভ হয়নি তাঁতিদের। দেশের বাজারে ভারতীয় নকল জামদানির দাপট, মহাজনদের দাদনের ফাঁদসহ নানান কারণে বহুমুখী সংকটে তাঁতিরা।

দাদনের ফাঁদ: দেশের প্রথম জিআই পণ্য (ভৌগোলিক নির্দেশক) জামদানি। বিশ্ব যখন বাংলাদেশকে জামদানির দেশ হিসেবে মূল্যায়ন করছে, তখন এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন খোদ জামদানিশিল্পীরাই। শতসহস্র বছর ধরে বংশপরম্পরায় টিকে থাকা এই শিল্পের কারিগরেরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে দূরে রাখছেন জামদানিশিল্প থেকে।

নোয়াপাড়া জামদানিপল্লির বাসিন্দা আল আমিন। তাঁর হাত ধরেই আবার মসলিন–যুগে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। তাঁতিদের সমস্যা নিয়ে আল আমিন বলেন, মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কাপড় বোনার পর বাধ্যতামূলকভাবেই সে কাপড় মহাজনদের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়। যে কাপড় তাঁতিদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় কেনা হয়, সেটাই শহরে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। অথচ নিজের দক্ষতা, শ্রম, সময় দেওয়ার পর দুজন তাঁতি খরচ বাদে সে কাপড়ের জন্য পাচ্ছেন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

আল আমিন বলেন, ‘ভালো জীবন দূরের কথা, আমরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় খাবারটুকুও পাইনি। শিল্পীরা মানুষের জন্য রঙিন পোশাক বোনেন, অথচ ঈদে নিজের সন্তানদের নতুন পোশাক দিতে পারেন না। আমরা গুটিকয় তাঁতি মহাজনদের এই ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।’

জামদানির কাজ শেখা জীবনের অপচয় ছাড়া বেশি কিছু নয় তাঁতি দ্বীন ইসলামের কাছে। ৫ জুন নোয়াপাড়া জামদানি শিল্পনগরীর ২ নম্বর গলিতে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একদিকে মহাজনদের দাদনের ফাঁদ, অপর দিকে দেশের বাজারে ভারতীয় মেশিনে বোনা নকল জামদানি। দ্বীন ইসলাম বলেন, যেসব শাড়ি তাঁরা ১০ হাজার টাকা খরচ করে বোনেন, অবিকল ভারতীয় নকল শাড়ি বাজারে বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়। নিজের পেশার ওপর বিরক্ত দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘মনে হয় এই জামদানির নেশায় পুরা জীবনই অপচয় করলাম। না খাইয়া মরলেও পোলাপানরে এই পেশায় আনমু না।’

মানিক মিয়া, আল আমিন, দ্বীন ইসলামের মতো নোয়াপাড়ার জামদানি তাঁতিদের অন্তত ১১ জন বলেন, দীর্ঘ সময় বসে থেকে সূক্ষ্ম সুতার কাজ করতে গিয়ে অল্প বয়সেই চোখ, মেরুদণ্ডসহ নানা রকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে তাঁদের। এর মধ্যে মহাজনদের দাদন, বাজারে ভারতীয় নকল জামদানি, বিসিক জামদানি শিল্পনগরীর অব্যবস্থাপনার ফলে দক্ষ কারিগরের সংকট, প্রয়োজনীয় ঋণ না পাওয়া, জামদানিপল্লির অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানান কারণেই দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছেন জামদানিশিল্পীরা।

ঋণ চান তাঁতিরা: জামদানিশিল্পের সংকট সমাধানে বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় নকল জামদানি বিক্রি বন্ধের পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ চান তাঁতিরা। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড প্রতি তিন বছরে তাঁতপ্রতি ৬০ হাজার টাকা ঋণ দেয়। দুটি শাড়ি বুনতেই সে টাকা খরচ হয়ে যায়। প্রতিবছর কম সুদে বড় অঙ্কের ঋণ পেলে মহাজনদের দাদনের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তাঁরা। এ ছাড়া বিসিকের পক্ষ থেকে নিয়মিত ঋণ দেওয়ার দাবি করেন তাঁতিরা। ভারতীয় নকল শাড়ির আমদানি বন্ধের পাশাপাশি আসল জামদানি চিহ্নিত করতে জিআই সনদপ্রাপ্ত জামদানি কারিগরদের বোনা শাড়িতে ট্যাগ ব্যবহার, সরকারি উদ্যোগে জামদানি রপ্তানি, জামদানি কারিগরদের সম্মিলিত সমবায় গড়ে তোলা হলে সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা।

তবে তাঁত বোর্ড রূপগঞ্জ উপজেলার ফিল্ড সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ সময়ই আগের ঋণ শোধ করতে গিয়ে ঋণের টাকা খরচ করে ফেলেন তাঁতিরা। তাঁরা মহাজনদের দেওয়া দাদনের দুষ্টু চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

ভারতীয় নকল জামদানিকে দেশের জামদানিশিল্পের জন্য অন্যতম হুমকি বলে মনে করেন জামদানি শিল্পনগরীর কর্মকর্তা শাহজাহান আলী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শ্রম ও মূল্যের বিচারে ভারতের মেশিনে তৈরি নকল জামদানির সঙ্গে দেশীয় জামদানির টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যেকোনো মূল্যে দেশের বাজারে ভারতীয় নকল জামদানি বিক্রি বন্ধ করতে হবে। অতীতে ঋণ নেওয়া অধিকাংশ তাঁতি ঋণখেলাপি হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাঁতিদের ঋণ দিতে চায় না বলেও জানান তিনি।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের পরিবার নিয়ে বসবাসসহ কারখানা নির্মাণের সুযোগ দিয়ে ১৯৯১ সালে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ায় জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই শিল্পনগরীতে বর্তমানে ৪০৭টি প্লটে প্রায় দুই হাজার তাঁত রয়েছে। শিল্প এলাকার তাঁতিদের অভিযোগ, শিল্প এলাকায় থাকা প্রায় পাঁচ হাজার বাসিন্দা দীর্ঘদিন ধরে নানা রকম অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন। ৫ জুন সকালে নোয়াপাড়া জামদানি শিল্পনগরী ঘুরে সেসব অভিযোগের সত্যতাও মেলে।

সরেজমিন দেখা যায়, জামদানিপল্লির সামনের সড়কটি একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী। সড়ক থেকে প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার একটি নালার ওপর দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। ৩ ও ৫ নম্বর গলিতে পানি জমে আছে। পানিতে ডুবে আছে নোয়াপাড়া জামদানি হাটের একাংশ। শিল্প এলাকার পুরোটাতেই ময়লা–আবর্জনার ছোট ছোট স্তূপ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। মোমেনা বেগম নামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ জানান, ঠিকভাবে শিল্প এলাকার বর্জ্য পরিষ্কার করা হয় না। নালাগুলো পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো শিল্পনগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

এ বিষয়ে শাহজাহান আলী বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে অধিকাংশ প্লটের কিস্তি ও সার্ভিস চার্জ বাকি আছে। তা ছাড়া কারিগরদের ব্যবহারের জন্য প্লট দিলেও বেশ কিছু প্লট বিসিককে না জানিয়েই বাইরের লোকজনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও আমরা সড়ক মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছি। সড়ক ঠিক হলে জলাবদ্ধতাও দূর হবে।’

ফিরে আসছে মসলিন: ঢাকাই মসলিন নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছিল দীর্ঘদিনের। রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া থেকেই প্রায় ২০০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মসলিন অবার ফিরে এসেছে দীর্ঘ প্রচেষ্টায়। সেই প্রচেষ্টার অন্যতম অংশীদার নোয়াপাড়া জামদানি শিল্পনগরীর বাসিন্দা আল আমিন। আল আমিন জানান, দৃকের সহযোগিতায় মসলিন বোনার মতো কঠিনতম কাজটিও তিনি করতে পেরেছেন তাঁর জামদানি বোনার অভিজ্ঞতা থেকে। ৩০০ কাউন্টের সুতায় মসলিন বোনা শুরু করলেও সর্বশেষ তিনি ৪০০ কাউন্টের সুতায় একটি শাড়ি বুনেছেন। আল আমিন বলেন, ‘মসলিন বোনা সাধনার বিষয়। জামদানি সেই সাধনার শুরুর স্তর। মসলিন হারিয়ে যাওয়ার পর, তা নিয়ে আমাদের কত আক্ষেপ! সেটা ফিরিয়ে আনতে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। মসলিনশিল্পের মতো জামদানিশিল্পটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

তাঁতিদের ভরসা শুক্রবারের হাট: বছরের পর বছর ধরে মহাজনদের বাইরে গিয়ে জামদানি বিক্রির জন্য তাঁতিদের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু শীতলক্ষ্যা পাড়ের নোয়াপাড়া ও ডেমরা বাজার হাট দুটো। প্রায় আড়াই শ বছর আগে নোয়াপাড়ার মসলিনের কারিগরেরা পাইকারদের সুবিধার কথা ভেবে ঢাকার ডেমরা বাজারে একটি হাট গড়ে তোলেন। মসলিন হারিয়ে গেলেও বর্তমানে জামদানি বিক্রি হচ্ছে হাটটিতে। তা ছাড়া নোয়াপাড়া শিল্পনগরীর ভেতরের জামদানি কারিগরদের জন্য ২০০১ সালে নোয়াপাড়া শিল্পনগরী জামদানি হাটটি গড়ে তোলে বিসিক। রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার জামাদানি তাঁতিরা নিজেদের হাতে বোনা জামদানি বিক্রি করেন এসব হাটে। প্রতি শুক্রবার ভোর পাঁচটায় শুরু হয়ে হাটগুলো চলে সকাল নয়টা পর্যন্ত। পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা এসব হাট থেকে জামদানি কেনার পাশাপাশি তাঁতিদের কাছ থেকে ফরমায়েশি জামদানি তৈরির সুযোগ পান। ৩ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে শাড়ি পাওয়া যায় এসব হাটে। শাড়ির পাশাপাশি হাটগুলোতে থ্রি–পিস, ওয়ান পিসও (পাঞ্জাবি ও শার্টের কাপড়) বিক্রি হয়।

বিসিক নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগীসহ নানান কারণে তাঁতিরা কাপড়ের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফলে অভাব–অনটনের শিকার এসব তাঁতি হতাশ হয়ে তাঁদের সন্তানদের এই শিল্প থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। এ কারণে জামদানিতে দক্ষ কারিগরের অভাব দেখা দিচ্ছে। তাঁতিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা গেলে অন্যান্য সংকটের সমাধান সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে তাঁতিদের অনলাইনে নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলায় সহায়তা করা হচ্ছে বলে জানান এই বিসিক কর্মকর্তা। পাশাপাশি ভারতসহ জামদানির চাহিদাসম্পন্ন দেশগুলো আরও বেশি মেলা আয়োজন করলে জামদানির আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।