ভিড় বেড়েছে লাশকাটা ঘরে

গত ১০ নভেম্বর রাত ১১টা। গাজীপুরের টঙ্গী পশ্চিম থানায় খবর আসে টঙ্গীর খরতৈল এলাকার ভাড়া ঘরে ঝুলছে এক পোশাকশ্রমিকের দেহ। দ্রুত পুলিশের দল গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। দিবাগত রাত তিনটার দিকে লাশ উদ্ধারের ‘লেখালেখি’ শেষ হতে না হতেই ওয়্যারলেসে ভেসে আসে সুরতরঙ্গ এলাকায় আরেকটি ঝুলন্ত লাশের খবর। পরদিন সকাল ও দুপুরে গুশলিয়া ও উত্তর আউচপাড়া এলাকা থেকে আরও দুটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁদের সবাই আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক ধারণার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের খাতায় এসবই অপমৃত্যু, মামলাও হয় ‘ইউডি বা অপমৃত্যুর’। পুলিশের তথ্য বলছে, করোনাকালে শিল্পঘন এই এলাকায় এমন অপমৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। গলায় ফাঁস দিয়ে, বিষপানে ও ট্রেনের নিচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহননের বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানা গেছে পুলিশের খাতা থেকে।

গাজীপুরের যেকোনো এলাকায় কারও অপমৃত্যু হলে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। পুলিশের ভাষ্য, এসব অপমৃত্যু মামলার প্রায় সবই আত্মহত্যা। গত তিন বছরে এই হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে ‘অপমৃত্যু মামলার’ ময়নাতদন্ত হয়েছে ১৭৯টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৪৭, ২০১৯ সালে ৫৪ এবং ২০২০ সালে ১১ মাসেই (নভেম্বর পর্যন্ত) ময়নাতদন্ত হয় ৭৮টি লাশের। ১১ মাসের হিসাবেই আগের বছরের চেয়ে ২০২০ সালে অপমৃত্যু বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

গত ১০ নভেম্বর রাতে টঙ্গীর খরতৈল এলাকার ভাড়া ঘর থেকে পোশাকশ্রমিক রফিকুল ইসলামের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, রফিকুল ওই এলাকার ভিয়েলাটেক্স সোয়েটার একটি কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। করোনার সময় রফিকুলসহ আরও কিছু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তিনি ছিলেন ঘরবন্দী, হতাশ।

বয়স বিবেচনায় ১১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের অপমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান শাফি মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে মারা যাওয়াদের প্রায় সবই আমরা আত্মহত্যার ঘটনা পাই। এর মধ্যে ৭০ ভাগ ফাঁসিতে ঝুলে ও ৩০ ভাগের মধ্যে বিষপানের কারণ।’ তিনি বলেন, পুলিশ মৃত্যুর কারণ প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়েই ইউডি মামলা করে। সে ক্ষেত্রে ইউডি মামলামূলে করা ময়নাতদন্তগুলোর প্রায় সবই অপমৃত্যু। এর মধ্যে বেশি থাকে আত্মহত্যার ঘটনা।

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে...
১৭টি অপমৃত্যুর মামলা নিয়ে পুলিশ, পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। এগুলোর সবই আত্মহত্যা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই সব ব্যক্তি আর্থিক অনটনে ছিলেন, কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন কয়েকজন। এ ছাড়া পারিবারিক কলহ, প্রেম—এসব নিয়েও বিষণ্ন ছিলেন কেউ কেউ।

গত ১৬ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একটি পোলট্রি খামারের ভেতর থেকে কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীর আলমের (৪০) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা ধারণা করে অপমৃত্যুর মামলা করে লাশ মর্গে পাঠায় পুলিশ।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের বাড়ি উপজেলার রাউৎকোনা গ্রামে। তিনি পোলট্রি খামার চালাতেন। করোনাকালে খামারে লোকসান হয়েছে, তাতে মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করেন তিনি। এরপর আর ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ায়নি। এদিকে পাওনাদারেরাও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। এরই একপর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর নিজ ফার্মের ভেতর তাঁর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়।

গাজীপুর একটি শিল্প–অধুষ্যিত এলাকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ এখানে চাকরি করতে আসেন। ২০২০ সালে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ মহামারি। করোনার কারণে এখানকার অনেকের চাকরি চলে গেছে, বেতন পাচ্ছেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যে খরাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে পারিবারিক ও মানসিক অশান্তি দেখা দিয়েছে।
মুকুল কুমার মল্লিক, গাজীপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য ও ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ

এর আগে গত ৬ ডিসেম্বর গাজীপুর শহরের নিরাপদ আবাসিক নামের একটি হোটেল থেকে জয়নাল আবেদিন নামের এক ব্যবসায়ীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর বাড়িও কাপাসিয়া উপজেলার বরুণ গ্রামে। তিনি ডিমের ব্যবসা করতেন। হোটেলের কক্ষের দরজা ভেঙে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ ও পরিবার সূত্র জানায়, জয়নাল দীর্ঘদিন ধরে ডিমের ব্যবসা করতেন। করোনাকালে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পাওনাদারেরা তাঁকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। টাকার জন্য তাঁর বাড়িতেও যেতে শুরু করলেন পাওনাদারেরা। সেই চাপ সামলাতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে লুকিয়ে ওই আবাসিক হোটেলে থাকছিলেন জয়নাল। এরই একপর্যায়ে হোটেলের কক্ষে তাঁর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়।

তার আগে গত ১০ নভেম্বর রাতে (শুরুতে উল্লিখিত) টঙ্গীর খরতৈল এলাকার ভাড়া ঘর থেকে পোশাকশ্রমিক রফিকুল ইসলামের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, রফিকুল ওই এলাকার ভিয়েলাটেক্স সোয়েটার একটি কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। করোনার সময় রফিকুলসহ আরও কিছু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তিনি ছিলেন ঘরবন্দী, হতাশ। তাঁর স্ত্রী আরেকটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। ১০ নভেম্বর রাতে কাজ থেকে ফিরে ঘরের ভেতর রফিকুলের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান খাদিজা।

পুলিশের ভাষ্য, এসব অপমৃত্যু মামলার প্রায় সবই আত্মহত্যা। গত তিন বছরে এই হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে ‘অপমৃত্যু মামলার’ ময়নাতদন্ত হয়েছে ১৭৯টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৪৭, ২০১৯ সালে ৫৪ এবং ২০২০ সালে ১১ মাসেই (নভেম্বর পর্যন্ত) ময়নাতদন্ত হয় ৭৮টি লাশের। ১১ মাসের হিসাবেই আগের বছরের চেয়ে ২০২০ সালে অপমৃত্যু বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

হাত বাড়িয়ে দিই
গাজীপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য ও ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুর একটি শিল্প–অধুষ্যিত এলাকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ এখানে চাকরি করতে আসেন। ২০২০ সালে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ মহামারি। করোনার কারণে এখানকার অনেকের চাকরি চলে গেছে, বেতন পাচ্ছেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যে খরাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে পারিবারিক ও মানসিক অশান্তি দেখা দিয়েছে।

বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের পাশে সবাইকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানালেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি পদে পদোন্নিতপ্রাপ্ত) মো. আজাদ মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার বিষয় নয়। এর জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। সবার উচিত সংবেদনশীল হওয়া, দায়িত্বশীল আচরণ করা। একই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে।