ভোটারদের দ্বারে দ্বারে কাউন্সিলর প্রার্থী হিজড়া সোনালি

নেত্রকোনার মদনে পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) হিজড়া সেজ্যেতি তালুকদার সোনালি
প্রথম আলো

‘হিজড়া হলেও আমি কখনো মানুষের কাছে হাত পাতিনি। সমাজের অবহেলিত হিজড়াদের জীবন মানোন্নয়ন, তাদের ভিক্ষাবৃত্তি ও চাঁদাবাজি দূর করে স্বাবলম্বী করা, দুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে আসছি। আমার আত্মীয় নাই, স্বজন নাই। আপন বলতে ভোটাররাই। এবারের পৌর নির্বাচনে আমি প্রার্থী হওয়ায় বর্তমান কাউন্সিলর হাবিবা আক্তার প্রার্থী হননি। সব ভোটারই আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন বলে আশা রাখি।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বললেন তৃতীয় লিঙ্গের সেজ্যেতি তালুকদার ওরফে সোনালি (৩১)। তিনি নেত্রকোনার মদন পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনের (৩, ৪ ও ৫) কাউন্সিলর প্রার্থী।
এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় এই প্রথম কোনো জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে হিজড়া প্রার্থী হয়েছেন। গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাচাই-বাছাইয়ে সেজ্যেতির মনোনয়নপত্রটি বৈধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে মদন পৌরসভা নির্বাচনে দাখিলকৃত মনোনয়নের হলফনামায় মামলাসংক্রান্ত তথ্য গোপন করায় সাতজন কাউন্সিলর প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়। যাচাই–বাছাইয়ে মেয়র, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪১ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে মেয়র পদে ৬ জন ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১৪ জন প্রার্থী হয়েছেন। সেজ্যেতির নির্বাচনী এলাকায় ভোটারসংখ্যা ৪ হাজার ৪৪১। তিনি নির্বাচন করছেন নারী প্রার্থী হিসেবে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চারজন প্রার্থী রয়েছেন।

হিজড়া হলেও আমি কখনো মানুষের কাছে হাত পাতিনি। সমাজের অবহেলিত হিজড়াদের জীবন মানোন্নয়ন, তাদের ভিক্ষাবৃত্তি ও চাঁদাবাজি দূর করে স্বাবলম্বী করা, দুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে আসছি।
সেজ্যেতি তালুকদার সোনালি, কাউন্সিলর প্রার্থী

সেজ্যেতির বাড়ি পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইমদাদপুর এলাকায়। বাবা সৈয়দ আক্কাস আলী। মা মৃত সখিনা আক্তার। ২০০৩ সালে তিনি যখন টি আমিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবেন এর ঠিক কিছুদিন আগে গৃহত্যাগী হয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আস্তে আস্তে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। একমাত্র মা ছাড়া পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। অবহেলার চোখে দেখা হতো তাঁকে। সহপাঠীরা এক বেঞ্চে বসতে চাইত না। উত্ত্যক্ত করত। অবশ্য ওই বিদ্যালয়ের তখনকার প্রধান শিক্ষক নিত্যনন্দ পাল ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক আনোয়ারা জেবুন্নেছা তাঁকে স্নেহ করতেন। ভালোবাসতেন। পরে তিনি হিজড়াদের জীবন-মান নিয়ে কাজ করে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হন। তিনি মদনে ‘স্বপ্নের ছোঁয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও সাধারণ সম্পাদক। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জয়িতা অনন্যা নামে আরেক হিজড়া। তাঁরা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস ২০১৯ উপলক্ষে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পান।
সেজ্যেতি জানান, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার অসহায়, গরিব ও অবহেলিত হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছি। তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতাসহ নানা সমস্যা সমাধানে পাশে থাকি। রাস্তাঘাট, নর্দমা, নলকূপ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়কবাতিসহ এলাকার মানুষের উপকার যেন সঠিকভাবে করে যেতে পারি, এই জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। করোনা মোকাবিলায় মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণসহ সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছি।’

এখনো সমাজে হিজড়াদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কেমন হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এলাকার মানুষের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কেমন, এটা প্রমাণ হবে ভোটের মাধ্যমে। এলাকার মুরব্বি ও সাধারণ জনগণের সমর্থনেই আমি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। আমি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সংরক্ষিত ওই আসনের বর্তমান কাউন্সিলর হাবিবা আক্তার এবার প্রার্থী হননি। এ ছাড়া ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর স্বপন মিয়া, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর বদরুল ইসলাম, স্থানীয় নেতা বাচ্চু ভূঁইয়া, নারী নেত্রী তহুরা আক্তার প্রমুখ আমাকে সমর্থন দিচ্ছেন।’ অবশ্য ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সেজ্যেতির কথার সত্যতা মেলে।
ভোটে জিতলে হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রসঙ্গে সেজ্যেতি বলেন, ‘জাত ভাইবোনদের তো আর ফেলে দেয় না কেউ। যদিও আমাকে আমার বাবা-বোন, আত্মীয়রা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পরিচয় দেয় না।’ এ কথা বলে তিনি কেঁদে চোখ মুছলেন। আবার মাথা তুলে বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুবার দেখা করেছি। তিনি খুবই মানবিক। তিনিই আমাদের বাবা, তিনিই আমাদের মা। তিনি আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমাদের উন্নয়নে ভাবছেন। কিন্তু কর্মকর্তারা ওনার মতো অতটা আন্তরিক নন। মদন উপজেলায় শতাধিক হিজড়া আছেন। এর মধ্যে ৩৩ জন মেডিকেলভাবে শনাক্ত। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ২০ জন ভাতা পান। অন্যরা কিছুই পান না।’

এলাকায় ভোট চাইতে গিয়ে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কেউ বাধা দেয় না। তবে কেউ কেউ দূর থেকে একটু মুচকি হাসে। উঁকি মারে। এটা ঠিক হয়ে যাবে। আর আমরাও তো বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট দিয়ে বিজয়ী করি। আমাকে কেন ভোট দেবে না?’
স্বপ্নের ছোঁয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি ও মদনের হিজড়া সরদার জয়িতা অনন্যা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেজ্যেতি একমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। জেলায় এর আগে কোনো হিজড়া নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সবাই আমাদের সহযোগিতা করছেন। ভোটাররা আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন বলে শতভাগ আশা রাখি।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলা কমিটির সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের মতো এ দেশে হিজড়ারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এটি একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের প্রত্যেকের উচিত তাঁদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা। ভোটারদেরও উচিত হিজড়াদের ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তন করা। তাঁদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা।’